ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ভাষা আন্দোলনের আদি কথা


১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান বিরক্ত হয়ে দুটি আলাদা জাতিগত রাষ্ট্র গঠন হয়। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান এবং ভারতের রাষ্ট্র হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস এবং ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। পাকিস্তানের অংশের সাথে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশটি চাপিয়ে দেওয়া হয়।

মূলত এক হাজার মাইল ব্যবধানে এই ছোট্ট খন্ড বাংলাদেশ। দুই অংশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষি, এমনকি যোগাযোগ কোন ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সাথে বাংলার এই অংশের মিল ছিল না। এটা স্বাভাবিক একটি বিষয় যে যেহেতু কোনো কিছুরই মিল ছিল না সে ক্ষেত্রে এত দূরত্ব একটি দেশের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মিলেমিশে থাকাটা অনেকটা কষ্টকর। নানা অনিয়ম বঞ্চনার কারণে, এবং শোষণের কারণ এই ভাষা নিয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বারবার ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যার বর্তমান নাম সরোয়ারদী উদ্যান সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সরস্বতী শতনাম না না করে প্রতিবাদ জানায়।

ভাষা আন্দোলনের তমুদ্দিন মজলিস


ভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম গঠিত হয় তমুদ্দিন মজলিস দোসরা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ‌ এই এই মজলিশ গঠিত হয় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে। এই সংগঠনের নেতৃত্বেই 15 সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এই নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটিতে মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবির বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।

তমুদ্দিন মজলিস এর বিশেষ অবদান


তমুদ্দিন মজলিশ গঠিত হওয়ার কারণে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবে এগোতে থাকে এরই ফলে পূর্ব বাংলার কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার কৃতি সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ গণপরিষদের অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবি করেন। তমুদ্দিন মজলিস এর কারণে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এখানে আহ্বায়ক নিয়োগ করা হয় নুরুল হক ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।

দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের দোসরা মার্চ।


২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালের গণপরিষদের কার্যক্রমে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ব্যবহার করে তখনই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করে। উনার প্রতিবাদের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিকভাবে ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রতিবাদ। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সাল ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে ধর্মঘট পালিত হয়। দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কমিটির আহবানে ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট পালিত হয়।ধর্মঘট পালিত মিছিল গুলোতে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হয়। এই মিছিল থেকে অনেকে গ্রেফতার হয়, উল্লেখ করার মতো ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মহল আন্দোলনকারীদের কে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করে এর কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালের ১৮ ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এসে বক্তব্যকালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন ‌। তাৎক্ষণিক ছাত্র-জনতা নানা বলে প্রতিবাদ করেন।১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলাকে আরবি হরফে লেখা প্রস্তাব করা হয়। তখন ভাষাবিদ ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন হয়। ১৯৫০ সালের ১১ ই মার্চ আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় প্রথম বারের মত। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। নাজিমুদ্দিন আগের প্রধানমন্ত্রীর মতো সুর মিলিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেয়, শুরু হয় পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়


ভাষা আন্দোলনের সময় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে বিশাল সমাবেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার কথা আবার বলেন। এই দিনটি ছিল ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি।

সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ


আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এখান থেকেই ২১ তারিখ সারাদিন হরতাল অবরোধ করার জন্য এবং বিক্ষোভ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন


এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিল নুরুল আমিন তিনি মিছিলের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আবুল হাশেম এর সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয় ২০ তারিখে। একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বর সেখানে ছাত্র-জনতার এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ২ তিনজন করে মিছিল বের করবে।

 সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিছিল বের করা হয়, কিন্তু শান্তিপূর্ণ মিছিলে পাকিস্তান বর্বর বাহিনী লাঠি চার্জ সহ কাঁদুনে গ্যাস, সর্বশেষ বুলেট নিক্ষেপ করে। মিছিলটি গণপরিষদের দিকে এগোতে থাকলে তাদের পুর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার শহীদ হন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল শহীদ আব্দুস সালাম। ২২ ফেব্রুয়ারি আবার গণবিক্ষোভ সূচনা হয়, এই দিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর। শহীদদের স্মরণ রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন, কিন্তু পুলিশ শীতের সময় ভেঙে দেয়। স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করার কাজে সহায়তা করে শহীদ শফিউরের পিতা এবং তাকে দিয়ে শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৩ সালে হামিদুর রহমান নকশা করে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলা কে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url