ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত|Beginning of Muslim rule in the Indian subcontinent

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে সাহসী বীর তুর্কি ইক্তেয়ার মোহাম্মদ দীন বক্তিয়ার খলজির মাধ্যমে।

তিনি ছিলেন নির্ভীক, ঝঞ্ঝার, দীর্ঘ দৃষ্টি শক্তির অধিকারী, তেজো ভরা বুক নিয়ে শুধুই সামনে আগানোর মানুষটি ইখতিয়ার মোহাম্মদ বক্তিয়ার খলজি।

ইখতিয়ার মোহাম্মদ বক্তিয়ার খলজি বাহ্যিক অবয়ব 


চেহারার সৌন্দর্য ছিলনা তার, দেখতে অনেক খাটো, শরীরের তুলনায় হংস যুগল বেশ লম্বা ছিল।

সৈনিক হিসেবে ব্যর্থ

তুর্কি থেকে আগত খলজি প্রথমে ভারতের শিহাবুদ্দীন ঘুড়ির সৈন্য বিভাগে এসে চাকরির জন্য আবেদন করেন কিন্তু ছোট আকারের কারণে সেখান থেকে সে প্রত্যাক্ষিত হয়। সেখান থেকে সে ছুটে চলে যায় সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক এর দরবারে। সেখানেও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। বারবার ব্যর্থতার কারণেও সে হাল ছেড়ে দেয় নি সফলতার জন্য। সেখান থেকে সে ছুটে চলে যায় বদ উনি , সেখানকার হিজড়উদ্ধন মাসিক বেতন এর শূন্য পদে চাকরি দেন। উচ্চ বিলাসী বক্তিয়ার খলজি অল্প বেতনের চাকরি বেশিদিন সেখানে করতে পারেনি, ছুটে চলে যায় আর এক শাসনকর্তা হুসাম উদ্দিন এর অধীনে । হুসাম উদ্দিন তাকে নিরীক্ষকের দায়িত্ব দেন রাজদরবারে।

হুসাম উদ্দিন শাসনকর্তার আস্থাভাজন ইক্তেয়ার মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী

ইখতিয়ার মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার দক্ষতার জন্য হুসাম উদ্দিন এর খুব সন্নিকটে চলে আসে। দরবারে তার কদর আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। হুসাম উদ্দিন তাকে মির্জাপুর জেলার দক্ষিণ পূর্বকোণে ভাগবত নামক জায়গা এবং পরগনার দুটি জায়গা দান করে। অল্পদিনের মধ্যেই সেখান থেকেই তিনি তার শাসন কার্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন

বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ


পরগনা এবং ভাগবত থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে আস্তে আস্তে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে। বক্তিয়ার খলজি সুদক্ষ পরিচালক ছিলেন যার জন্য ধারাবাহিকভাবে তার দলের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিভিন্ন রাজ্য জয় করা ও তার জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে। অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য গুলোকে আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ এবং সাথে সাথে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটি আর উদ্দিন যে অঞ্চলগুলো আক্রমণ করে নিজের দখলে আনে শুধুমাত্র সেখানে সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য হয়না, সেই অঞ্চলে তার শাসন কার্য পরিচালনার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তিনি প্রথমে দক্ষিণ বিহারের একটি দুর্গ আক্রমণ করে কিন্তু সেখান থেকে কোন সম্পত্তি পায় নি কারণ সেটি ছিল একটি বৌদ্ধ বিহার। সেখান থেকে আলামত হিসেবে শুধুমাত্র পাওয়া যায় বই-পুস্তক আর খন্ডিত মস্তিষ্ক।

বিহার বিজয়ের পর ইফতার গ্রীন দিল্লির সুলতান হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরামর্শে বিপুল পরিমাণ শক্তি সংগ্রহ করে নবদ্বীপে আক্রমণ চালায় নদীয়া নামে পরিচিত ছিল। সেন বংশের লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া নবদ্বীপের ছিল, সেই সময়ে নবদ্বীপে অবস্থান করছিল। নবদ্বীপ বা নদিয়া দখলটা প্রথমত এত সহজ ছিল না জয় করার জন্য সহজ ছিল না জয় করার জন্য। এজন্য একটি আর উদ্দিন বখতিয়ার খলজি খুব কৌশলী পন্থা অবলম্বন করে। নদিয়ায় আসার জন্যে তেলিয়াগড় ও শিকড়িগড় এই দুই গিরিপথ দিয়ে আসতে হয়। এই দুই গিরিপথ ছিল খুবই সুরক্ষিত সৈন্যবাহিনী দিয়ে সুসজ্জিত।

বক্তিয়ার খলজি এই পথ দিয়ে না এসে তার সৈন্যবাহিনীকে দলে দলে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন পথে আসার পরামর্শ দেয়। দক্ষ অশ্বারোহী ইক্তেয়ার খলজী মাত্র ১৭ টি অশ্বারোহী নিয়ে অতর্কিতভাবে লক্ষণ সেনের দরবারে প্রবেশ করে। লক্ষণ সেন মনে করে ঘোড়া বিক্রির উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, পৌছেই রাজদরবারের সকল সুরক্ষিত সৈন্যদেরকে এলোপাতাড়ি হত্যা শুরু করেন। লক্ষণ সেন প্রীত শঙ্কিত হয়ে যুদ্ধ না করে, স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে দুর্গের পিছনের দরজা দিয়ে কুটির ত্যাগে বাধ্য হয়। ক্ষিপ্ত গতির কারণে মাত্র ১৭ টি অশ্বারোহী বক্তিয়ার খলজির সাথে দরবারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বাকি সৈন্যদল পর্যায়ক্রমে দরবারে উপস্থিত হয়। এখানে উল্লেখ করার মতো ঠিক দুপুর বেলায় লক্ষণ সেন এর দরবারে বক্তিয়ার খলজি আক্রমণ করেন। লক্ষণ সেন পালিয়ে কোন মত প্রাণ রক্ষা করে এসে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে। ঐতিহাসিকভাবে এই বিজয় কে বক্তিয়ার খলজির এক সাহসিক বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই বিজয় লাভ করে।

বখতিয়ার খলজির গৌড় শাসন


নদিয়া দখলের পর বক্তিয়ার খলজি ঘড়ির দিকে অগ্রসর হয় সেখানে তার রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে তার সম্রাজ্য প্রসারের জন্য এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য মাদ্রাসা, মসজিদ মক্তব চালু করে ‌
এখানে বিজয় করেই সে শুধু ক্ষান্ত হয়নি এরপর সে বরেন্দ্র অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয় এবং সে অঞ্চলকে জয় করে।

বখতিয়ার খলজির বিশেষ সাফল্য


বক্তিয়ার খলজি মুসলিম শাসনের এক অনন্য শাসক হিসেবে পরিচিত লাভ করে। তিনি বাংলার সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের ভিত্তি করে। তার সুদক্ষ শাসন এর জন্য বাংলায় মুসলমানরা প্রায় পাঁচশত বছর স্থায়ী ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পেরেছিল। তার শাসনকার্যের সাধারণ মানুষ এবং প্রজারা তার প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ছিল। তার দরবারে শফি সাহিত্যিক কবিদের খুবই মূল্যায়ন করা হতো। ইসলামী সাহিত্য ও ধর্মীয় চর্চায় তিনি এক ধাপ এগিয়ে ছিল। ইসলামী সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য মসজিদগুলোতে তিনি নিয়মিত কবিতার আসর জলসার আয়োজন করত। তিন অসংখ্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল। রক্তপাত ছাড়াও অনেক অভিযানে তিনি সফলভাবে অভিযান সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজ্য জয় করায় শুধু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সাম্রাজ্য বিস্তৃতি ইসলামী প্রসারে অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন।


বখতিয়ার খলজির শেষ অভিযান


তিব্বত অভিযানে তার শেষ অভিযান ছিল। এবে জানে তিনি কিছুটা ব্যর্থ হয়ে দেবকোট নামক স্থানে ফিরে আসেন। বিষয়টিকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবেও ব্যাখ্যা করার সুযোগ ছিল না। অসুস্থতার কারণে অনেকটাই তাকে অভিযান থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল। রাজ্যের অলি মর্দান নামের একজন আমি তাকে হত্যা করেছিল। তার মৃত্যুর সাল হিসেবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ কে ধরা হয়।

ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী মৃত্যুর পর বাংলায় তুর্কি শাসন ব্যবস্থা


বক্তিয়ার খলজির মৃত্যুর পর থেকে প্রায় ৬০ বছর তুর্কি শাসক দল বাংলায় শাসন করেছে। এই সময় তারা বিচ্ছিন্নভাবে শাসন করেছে। ইতিহাস মতে পাওয়া যায় ১৫ জন শাসনকর্তা এই সময় বাংলা শাসন করেছে। এদের মধ্যে 10 জন ছিল যারা দাস। দাসদের তখন মামলুক বলে ডাকা হতো। এজন্য এই সময়কে অনেকে মামলুক শাসন বলেও আখ্যায়িত করেছে। এই সময় রাজ্যে এবং ছোট ছোট রাজ্য ভারতে বিভিন্ন গোলযোগ, বিশৃংখলা, অরাজকতা, হানাহানি লেগেই থাকত। মূলত ইক্তেয়ার খলজির মৃত্যুর কারণে দিল্লির এই অঞ্চলগুলো শাসনকার্য পরিচালনা , অনেকটা অমনোযোগী হয়ে ওঠে। এই সময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ দিল্লির নতুন শাসন কার্য পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা কিছুটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। নাসির উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন দিল্লি ইলতুৎমিশের পুত্র। ইলতুৎমিস এর মৃত্যু হলে রাজ্যে আবার গোলযোগ সৃষ্টি হয়, এই সুযোগে আওর খান আইবক নামের এক ব্যক্তি লখনৌতির ক্ষমতা দখল করেন।

কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি বিহারের শাসনকর্তা তুঘরন তুঘানের হাতে পরাজিত হন। তুঘান খান দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন এরপর লখনৌতির ক্ষমতা নাই ওমর খান। এরপর ১২৪৭ থেকে ১২৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে আলাউদ্দিন মাসুদ। তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। ১২৫১ থেকে ১২৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চার বছর শাসনভার গ্রহণ করে মুঘিস উদ্দিন উপাধি নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন  ইউজবুক।তিনি ১২৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন, এরপর তাজুদ্দিন আরসালান খান সিংহাসনে বসেন। তিনি দিল্লি সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও সম্পর্ক বেশিদিন এগোয়নি। এর মধ্যে অল্প দিনের জন্য শেরখান ক্ষমতায় বসেন।

পরবর্তীতে তুগ্রিল ছিলেন তুর্কিদের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তিনি একাধারে ঢাকা বিক্রমপুর অঞ্চলের বেশ কিছু অঞ্চল তার শাসনের আওতায় নিয়ে এসেছিল। তিনি সোনারগাঁ অঞ্চলে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল নাম দিয়েছিল নারকেল দুর্গ। সাধারণ মানুষ দূর্গটি কে তুগরিল দুগ হিসাবে চিনত। তুঘরিল বাংলা শাসন করেছে মুঘিস উদ্দিন উপাধি নিয়ে। সর্বশেষ গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এর হাতে পরাজিত হয় এবং শাসন কার্য দিল্লির অধীনে চলে যায় উল্লেখ্য যে এরপর থেকেই ১৩৩৮ পর্যন্ত বাংলা দিল্লির অধীনে ছিল।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url