যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ইতিহাস
Admin
10:38 AM
যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর।
যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্য
রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয় কোন্দল, অঞ্চলভেদে বৈষম্য, অর্থনৈতি শোষণ হতে মানবতার মুক্তির উদ্দেশ্যে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। নিচে যুক্ত ফ্রন্টের দল সমূহের নাম উল্লেখ করা হলো:
১. আওয়ামী মুসলিম লীগ
২. কৃষক শ্রমিক পার্টি
৩. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
৪. নেজামে ইসলাম
পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস এই দলগুলো মূলত সৃষ্টি হয় পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের শাসন এর ব্যর্থতার কারণে।
যুক্তফ্রন্ট গঠিত দলসমূহ
চারটি দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।
👉আওয়ামী মুসলিম লীগ যা ⸻ মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে।
👉কৃষক শ্রমিক পার্টি ⸻ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে
👉নিজাম ইসলামী পার্টি ⸻ মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে
👉খেলাফত রাব্বানী পার্টি ⸻ হাজী দানেশে নেতৃত্বে
নানা টালবাহানার পর 1954 সালের 8 ই মার্চ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে নৌকা কে সিলেক্ট করা হয়।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবিসমূহ
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ২১ দফা কর্মসূচি দেওয়া হয়। এই কর্মসূচির রচয়িতা ছিলেন আবুল মনসুর আহমেদ। ২১ দফার প্রধান দাবিগুলো হলো।
১. বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা
২. পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করা
৩. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রসার
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান
৪. কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা চালু
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ
৫. একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ ডিভোর্স হিসেবে সরকারি ছুটি
৬. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে স্বায়ত্তশাসন
৭. আইন পরিষদের মেয়াদ কোন ভাবে বৃদ্ধি না করা
৮. আইন পরিষদের আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন দিয়ে তা পূরণ করার ব্যবস্থা।
যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য দাবি সমূহ
- বর্ধমান হাউস কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি গবেষণাগারে পরিণত করা বা পরিণত করতে হবে।
- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নিহতদের জন্য একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে।
- একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত করতে হবে।
- যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কর্তৃক আইনসভার কার্যকাল বৃদ্ধি করা যাবে না সেই সাথে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ছয় মাসের আগেই মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করতে হবে।
- আইনসভার কোন সদস্য মারা গেলে বা অন্য কোন কারণে পদত্যাগ করলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনে ব্যবস্থা করতে হবে।
- জননিরাপত্তা আইন এবং অর ডান্স এর মাধ্যমে সকল বন্দীদের মুক্তি দান এবং সকল কিছুর বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
- সকল প্রকার দুর্নীতি ঘুষ রাহাজানি বন্ধ করতে হবে।
- যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ফলাফল
- সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধ্য বৈষম্য দূর করতে হবে।
- প্রশাসনিক ব্যয় এবং সরকারের উচ্চ এবং নিম্ন পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে।
এই নির্বাচনন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়েছে। এই নির্বাচনে শতকরা ৩৭.১৯ ভাগ ভোট দেয়। দোসরা এপ্রিল সরকারিভাবেই নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়। মোট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩ টি আসন লাভ করে। ক্ষমতায় থাকা মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি আসন।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের তাৎপর্য
এই নির্বাচন ছিল মূলত মুসলিম লীগের অন্যায় বৈষম্য, ব্যর্থ শোষণের প্রতিবাদ। নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব ফুটে উঠে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব পথ সুগম হয়। এর পিছনে কারণ হচ্ছে অনেক তরুণ প্রার্থীর কাছে মুসলিম লীগের অনেক প্রবীণ নেতা হেরে যায়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা সৃষ্টি হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদ আদর্শের ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু হয়। এই নির্বাচনে যুক্তবর্ণ সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী লাভ করা হয় আগামী দিনের নেতৃত্তের পথ সুগম হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন
শেরেবাংলা হকের নেতৃত্বে 14 সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব বন্টন হয়। এখানে আবু হোসেন সরকার স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী পায়। সৈয়দ আজিজুল হককে শিক্ষা মন্ত্রী বানানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, কৃষি সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন দায়িত্ব দেয়া হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিলের কারণ সমূহ
যুক্তফ্রন্টের বিজয় কে কখনোই সুনজরে দেখতে পায়নি মুসলিম লীগ। এজন্য যুক্তফ্রন্টের সরকারকে উৎখাত করার জন্য নানা টালবাহানা শুরু করে, তাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করার জন্য, বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমগ্র দেশে গোলযোগ সৃষ্টির জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন এবং বর্ধমান হাউস কে বাংলার গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় আদমজী জুট মিলে বাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। মুসলিম লীগ এই দায়ভার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করে। এই সময় নিউজ টাইম পত্রিকা ফজলুল হকের বিবৃতিকে উল্টো করে পত্রিকা প্রকাশ করেন, পত্রিকার শিরোনাম দেওয়া হয় পূর্ব বাংলা র আলাদা রাষ্ট্র। অর্থাৎ বোঝানো হয় পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চায়। এতে মুসলিম লীগ তাকে রাষ্ট্রদোহী বলে ঘোষণা দেয়। অবশেষে মুসলিম লীগ সংবিধান অনুযায়ী যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় কে অবৈধ ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা মাত্র 56 দিন টিকে ছিল। আভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণে মাত্র চার মাসের 7 মন্ত্রিসভার পতন হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ সমূহ: এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের নানাবিধ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ গুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো
মুসলিম লীগের স্বার্থনেশি মনোভাব পোষণ: পূর্ববাংলার জনসাধারণের স্বার্থের প্রতি মুসলিম লীগের সাধারণ নেতৃবৃন্দ এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। এই দলটি ইউ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার বিরোধিতা করে। কিন্তু এসবের মাঝে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করে।
আদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং অন্ত দ্বন্দ্ব সংঘাত: আদর্শগত এবং নিজেদের অন্তদ্বন্দ্ব সংঘাতে দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্টের কার্যক্রম ছিল আকর্ষণীয় সাধারণ জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো।
একুশের মর্মান্তিক ঘটনা: পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আদর্শ পূর্ববাংলার শতকরা ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। তাদের চক্রান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান নিয়ে রাজপথে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। তখন মুসলিম লীগের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এবং তার নির্দেশে পুলিশ বাহিনী মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করে। মৃত্যুর মুখে পতিত হয় সালাম বরকত রফিক সহ আরো অনেকে। এর ফলশ্রুতিতে মুসলিম লীগের পরাজয় যুক্তফ্রন্টের বিজয় ত্বরান্বিত হয়।
সংবিধান প্রণয়নের ব্যর্থ: স্বার্থান্বেষী মুসলিম লীগ ক্ষমতায় এসে গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা দ্রুতগতিতে সংবিধান প্রণয়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। যার ফলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে যায়। যুক্তফ্রন্ট বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
লাহোর প্রস্তাব মেনে না নেওয়া: ১৯৪০ সালের উপস্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের সংখ্যাগরিষ্ঠতা শুধু মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের কথা উল্লেখ করার মতো ঘটনাকে পত্রিকায় ভুলবশত ছাপা হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।পরে তা সংশোধন করা হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
অগণতান্ত্রিক মনোভাব: টাঙ্গাইলের এক উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের কারণে মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটে। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন স্থগিত রেখে মুসলিম লীগ প্রাদেশিক আইন সভার মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে দেয়। এ ধরনের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ফলে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দারুণভাবে কমতে থাকে।
নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ: মুসলিম লীগের পরাজয়ের নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে জনগণের শোষণ বঞ্চনা। মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষের আন্দোলনকে অনেক দেশদ্রোহী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে, এটি নির্যাতনের মাত্রা কে দারুণভাবে বিষিয়ে তোলে।বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের এরকম আচরণ সাধারণ জনগণকে খুবই ক্ষুব্ধ করে তুলে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা: প্রশাসনের ব্যর্থতা মুসলিম লীগের পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ। মুসলিম লীগ সরকারের অধীনস্থ প্রশাসন খাদ্য সমস্যা, লবণ, বন্যাকবলিত এলাকার জনগণের সমস্যা নিরূপণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
চাকরি পরীক্ষার যেভাবে প্রশ্ন হতে পারে
• যুক্তফ্রন্ট কখন গঠিত হয়?
• যুক্তফ্রন্ট কয়টি দল ছিল?
• যুক্তফ্রন্টের প্রতীকি ছিল
• যুক্তফ্রন্ট সরকার কতদিন ছিল?
• যুক্তফ্রন্টের দফা কয়টি ছিল? প্রধান দফা কয়টি?
• মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ?
• যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিলের কারণ?
• যুক্তফ্রন্ট কি?
• যুক্তফ্রন্ট গঠনের কারণ কি ছিল?
• যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার চার দলের প্রধানের নাম কি?