১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ ও এর ফলাফল কি

গণঅভ্যুত্থান কি?

গণ শব্দের অর্থ সাধারণ জনগণ আর অভ্যুত্থান অর্থ আকস্মিক জেগে উঠা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা, ফুঁসে ওঠা, একত্রিত হয়ে জবাব দোয়া এছাড়া বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ধরনের শব্দ রয়েছে।

পাকিস্তান শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন চৌধুরী রহমত আলী আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণ নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বৈষম্যের দেওয়াল অনেক উঁচু হয়ে উঠতে থাকে। অর্থনৈতিক শোষণ রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয় এদেশের জনগণ। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ৬৯ এর ছাত্র সমাজের ১১ দফা তৎকালীন আওয়ামী লীগের ৬ দফা পাকিস্তান সরকার মেনে নিতে পারেনি। এই দফার ভিত্তিতে আন্দোলন চালানো হলে পাকিস্তান সরকার মেনে না নিয়ে উল্টো তার বিরুদ্ধে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানোর চেষ্টা করা হয়। বরং এই আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে আখ্যায়িত করা হয় ‌

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যগুলো


১. গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠা করা।
২. পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা স্বায়ত্তশাসন।
৩. দুই পাকিস্তানের বিরোধ মীমাংসা করা
৪. সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা, অফিসারদের মধ্য দূরত্ব কমিয়ে আনা অর্থাৎ বৈষম্য দূর করা।
৫. দ্রুত সকল মিথ্যা অন্যায় মূলক মামলা প্রত্যাহার করা এবং সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া।
৬. রাজনৈতিক দমন নিপীড়ন বন্ধ করা
৭. সকল গণআন্দোলন বিরোধী এবং অশুভ শক্তির উপড়ে ফেলা।

১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুথানের বিভিন্ন ঘটনার ধাপসমূহ


১৯৬৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পাকিস্তান জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য বিভিন্ন মহল বিভিন্ন শ্রেণি একই প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। এ আন্দোলন প্রথম শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাসে তবে ঠিক জানুয়ারি বললে ভুল হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে এই আন্দোলন ফেব্রুয়ারি ২২ তারিখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে গণঅভ্যুত্থানের এই আন্দোলন ৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকেই মূলত শুরু হয়েছিল।

৬৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই আবৃতি আন্দোলন দিনের-পর-দিন তীব্র তার দিকে এগোতে থাকে এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। দীর্ঘদিনের বৈষ্যমের শিকার জনগোষ্ঠী  মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য মরন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা শপথ বাক্য পাঠ করে গতিময় আন্দোলনের জন্য জনগণকে সঙ্গ বদ্ধ করে। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ৬ ডিসেম্বর ৬৮ সালে পল্টন ময়দানে এক জনসমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ থেকেই সর্বপ্রথম আগরতলা মামলার আসামি যিনি ১ নং আসামী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি করে ঘরে আনার ডাক দেন। এরই মধ্য দিয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন নতুন রূপরেখা উপনীত হয়।

জনগণ আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। তখন সাধারন জনগন পল্টন ময়দানে সমাবেশে জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো এই শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে। এই সমাবেশ থেকেই সারাদেশে ৭ ডিসেম্বর হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সাধারণ শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ হরতাল পালনে অংশগ্রহণ করে। বর্তমান বহুল প্রচলিত তৎকালীন ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় হরতালকারীদের উদ্দেশ্যে পুলিশ গুলি চালায়। এই সময় পুলিশের গুলিতে দুইজন লোক নিহত হন। একজন ইসহাক অন্যজন আব্দুল মজিদ নাম। এইদিন শহরের বিভিন্ন জায়গায় খণ্ড খণ্ডভাবে সংঘর্ষ হয়। এই হরতালে মোট তিনজন নিহত, ৫০ জনের মতো আহত, প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি গ্রেফতার হন। নিহতদের স্মরণে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সবার সিদ্ধান্তে গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এই চরম ক্রান্তিকালে গায়েবি জানাজা হতে অনেক লোক গ্রেপ্তার হয়।

১৯৬৯ সালের আন্দোলনের চরম পর্যায়


গণতন্ত্রের মূল পর্ব শুরু হয় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯। তখন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং ছাত্র সমাজের একটি কমিটি গঠন হয়। এই দুই কমিটি গঠনের পর থেকেই মূলত আন্দোলন একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা হয়। আন্দোলনটা অনেকটা আত্মঘাতী আন্দোলনে রূপ নেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কড়া নিরাপত্তা, হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও বাংলার সাধারন মানুষ দমিনি তারা একের পর এক নতুন রূপে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মতে ১৭ জানুয়ারি দাবি দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বার কাউন্সিলের লাইব্রেরীতে একটি সভার আয়োজন করা হয়।

এখানে উল্লেখ করার মতো ৭ ডিসেম্বর থেকেই ১৪৪ ধারা জারি ছিল। সকালবেলা ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাবেশ করে অন্যদিকে সংগ্রাম কমিটি বার কাউন্সিল লাইব্রেরি তে বিকেল একটি বৈঠক করেন। ছাত্র কমিটির দায়িত্ব ছিল তোফায়েল আহমেদ। ছাত্র কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ছাত্রজনতা আন্দোলন করলে পুলিশ তাদের মিছিলে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কাঁদুনে গ্যাস এর সাথে সাথে ব্যাপক পরিমাণে লাঠিচার্জ করা হয়। এদিনও পুলিশ ইপিআর বাহিনী অনেক ছাত্রদের অ্যারেস্ট করেন। কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবনে হামলা করেছিল। ১৭ ই জানুয়ারি ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর হামলার প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ১১ দফার আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে পুনরায় ধর্মঘট অবস্থান শুরু হয়।

ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচি গুলো


১. হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল সাথে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল। বাংলা ভাষাকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রদের অবৈতনিক শিক্ষা, ছাত্র দের বেতন কমানো।
২. ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সব
৩.  ব্যাংক-বীমা ইন্সুরেন্স এবং বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা
৪. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি এবং কাজের বোনাস প্রদান।
৫. পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পানি সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রদান।
৬. জরুরি অবস্থা, নিরাপত্তা আইন বাতিল করা।
৭ সিয়াটো, সেন্টু, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং সেইসঙ্গে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করা।
৮. সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ইত্তেফাক পত্রিকা ওপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল।
৯. কৃষকদের খাজনা মওকুফ, সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল
১০. পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি রাজ্য বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ এগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রদান আর পশ্চিমা অংশকে নিয়ে একটি সাব ফেডারেশন গঠন করা।
১১. সকল রাজবন্দিদের গ্রেপ্তার প্রত্যাহার করা এবং সেই সাথে আগরতলা মামলা বাতিল ঘোষণা করা।

এই ১১ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য স্লোগান দিতে থাকে। ১৭ ই জানুয়ারি খণ্ড খণ্ডভাবে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে মিছিল বের হয় এই দিন পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আসাদুজ্জামান এর মৃত্যুর খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন এক চরম রূপ নেয়। এই দিনেই দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শোকসভার আয়োজন করা হয়। এইসব সভা থেকে আগামী তিন দিন শোক কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল ২১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে হরতাল, ২২ জানুয়ারি মিছিল এবং প্রতিবাদ সভা এবং ২৩ জনুয়ারি মশাল মিছিল বের করা হবে।

যথারীতি ভাবে সকল কর্মসূচী বাস্তবায়ন হয় এবং ২৩ জনুয়ারি মশাল মিছিল থেকেই ২৪ জানুয়ারি ঢাকা শহরে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। এখানে তুলে ধরা দরকার আসাদের নাম অনুসারেই বর্তমান ঢাকায় আসাদগেট। ২৪ জনুয়ারি স্মরণীয় রাখতে এই দিনটিকে গণ অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই দিন এতটা আন্দোলন হয় সেক্রেট ভবন, ঢাকা শহরের সরকারি অফিস গুলো, সরকারপন্থী পত্রিকা অফিস গুলো ঘেরাও এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা ঢাকা শহরের চিত্র অন্যরকম হয়ে ওঠে, দীর্ঘদিনের অত্যাচারের ফুলে ওঠা মানুষগুলো বাঘের নয় হুঙ্কার শুরু করে যানবাহন গুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকা শহর সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। 

পাকিস্তান সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। এর মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের পেটোয়া বাহিনী মিছিল গুলোতে হামলা এবং গুলিবর্ষণ করে তখন নবকুমার ইনস্টিটিউট এর ছাত্র মতিউর রহমান আরেক তরুণ শেখ রুস্তম আলী নিহত হন। ২৫ জানুয়ারি আরো দুইজন বাবুল এবং আনোয়ার নিহত হন। ২৪ জানুয়ারির আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে সরকার নানাভাবে ধরপাকড় শুরু করে শুরু হয় নতুন ভাবে গুম-হত্যা । এভাবে সংগ্রহ পাকিস্তানের কোন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এসব কিছুর পরেও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন থেকে নিপীড়িত জনগোষ্ঠির তিলমাত্র সরে আসে না। পরিস্থিতির ২১ দিন পর কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তারা বিরোধী দলগুলো কে বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে আলোচনায় বসতে চায় কিন্তু নেতৃবৃন্দের মুক্তি না দেওয়ায় বিরোধী দল তাদের আলোচনায় কান দেয় না।

আন্দোলনের তীব্রতা দেখে পাকিস্তান সরকার ১১ ই ফেব্রুয়ারি ৬৯ প্রতিরক্ষা আইন বলে গ্রেপ্তারকৃতদের বিনা শর্তে মুক্তোদানার ঘোষণা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে ১২ ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিনকে মুক্তি দেওয়া হয়। এটি ছিল ১১ দফা আন্দোলনের প্রথম বিজয়। পরের বিষয়টি ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া। এক দুই দিন পরেই আবার নতুন আন্দোলন শুরু হয় অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি নতুন দুটি মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আগরতলা মামলার একজন অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক কে যিনি ১৭ নং আসামী ছিলেন নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা আবার চরম গরম অবস্থা হয়ে ওঠে। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সভা, সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা হয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কি করা হয় সেই বিষয়ে নতুনভাবে চিন্তা শুরু হয়।

এইসময় জাতির জনক কে নিয়ে জীবন বিপন্ন সংশয় দেখা দেয়। এই সময় আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এস রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে এবং বাসভবনের চারপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৬ তারিখ সান্ধ্য আইন জারি করা হয় সেনাবাহিনীর সহায়তায়। ১৭ তারিখ কোনমতে পার হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি গা শিউরে করার মত আরেকটি নতুন ঘটনার জন্ম দেয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহা গুলি করে হত্যা করে। শুধু গুলো করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি ডক্টর শামসুজ্জোহার উপর বেয়নেট সার্চ করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। অনেকটা চেঙ্গিস খানের হত্যার সাথে তুলনীয়।

ডঃ শামসুজ্জোহা মৃত্যুর খবরে সন্ধ্যা আইন অপেক্ষা করে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদের জন্য বেরিয়ে আসে। সেই রাতেও পুলিশ বাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করেছে। অনেকেই এই রাতে আহত ও নিহত হয়েছে। অবশেষে পরেরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্য আইন বাতিল করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সময় নির্লজ্জ আইয়ুব খান ঘোষণা দেন টিনিয়া নির্বাচন করবে না। ২২ ফেব্রুয়ারি ৬৯ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পল্টন ময়দানের সমাবেশে তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। তোফায়েল আমি তখন ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণ সমূহ


গণঅভ্যুত্থানের নানাবিধ কারণে রয়েছে নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ দেখানো হলো:

১. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের ফলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয় হয়। যার জন্য গণতান্ত্রিক পথ অনেকটা আটকা পড়ে যায়। গণতন্ত্র ফেরা বার জন্য পথ খুঁজতে থাকে। এতে জনগণের আশা আকাঙ্খার ভরাডুবি দেখা যায়।

২. আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈষম্য দিন দিন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সাতচল্লিশ সালের পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই আর্থসামাজিক ভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের অংশে থাকে উন্নয়নের লেশমাত্র সেখানে লাগেনি। ৬৮ সালকে পাকিস্তান সরকার অর্থাৎ আইয়ুব খান উন্নয়নের দর্শক হিসেবে ঘোষণা করে কিন্তু পূর্বপাকিস্তানে লেশমাত্র উন্নয়ন হয়নি।

৩. মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে আইয়ুব খানকে ধরা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর একটি আদেশ জারি করে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেন। তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ের ৮০ হাজার লোকের উপর ভোটাধিকার দেয়। যার পেক্ষাপটে ভোট যাদের আছে তাদের ক্ষমতার দাপট অনেকটা বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, হতাশা বিরাজ করে। যার মাধ্যমে ঘুষ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বৃদ্ধি পায়।

৪. সরকারের দমন নির্যাতন পুলিশি ব্যবস্থা
বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে পুলিশি নির্যাতন, অন্যায় ভাবে হত্যা, গ্রম, ক্রসফায়ার এগুলোর জন্য সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। এই সময় জেল জুলুম, নির্যাতনের মাত্রা আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আইয়ুব খানের উত্তরসূরী আব্দুল মোনায়েম খান ক্ষমতা নেওয়ার পর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। তিনি বিভিন্ন ধরনের বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাস্তবায়ন করে । যেমন রয়েছে এস এফ বাহিনী পিয়ার বাহিনী। এসব বাহিনীর কাজ ছিল মিছিল-সমাবেশে আক্রমণ করা ধরপাকড় করো।

৫. বাঙ্গালীদের মুক্তির আন্দোলন অন্যতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগী ৩৪ জন যারা আগরতলা মামলার আসামি ছিল তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারকার্য শুরু করা। এসব বিষয় বাঙালির সাধারণ মানুষ কখনো মেনে নিতে পারেনি। প্রহসন মূলক নাটক অন্যায় ভাবে জেল-জুলুম বাঙালি কখন মাথা পেতে নেয় নি।

৬. কালক্ষেপণ করে বিভিন্ন ধরনের বৈঠকের আহ্বান করে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া। অবশ্য বাঙালি এভাবে কখনো মিথ্যা মরীচিকার পিছনে ছুটেনী।

৭. আইয়ুব খানের ১০ বছরের সামরিক শাসনে যে পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে তা পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র পাঁচটি পরিবারের হাতে এসে সম্পদের সমাবেশ ঘটেছিল। এই সামান্য পরিমাণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কোন ভূমিকা রাখেনি।

৮. ৫৯ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খানের রাজনৈতিক প্রতি হিংসা গোটা দেশ থেকে নানা দিক থেকে বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দেয়। যার প্রেক্ষিতে দুর্নীতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসী বেড়ে যায়। এই সময় বাংলার মাটিতে বিভিন্ন ধরনের মীরজাফরের চরিত্র দেখা যায়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url