কারবালা ট্রাজেডির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইয়াজিদ একাধারে নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক শাসন ব্যাপারে তিনি ন্যায় - অন্যায়ের কোনো ধার ধারতেন না। যেমন নাচ ও পাপাসন্ত ছিল, তার আমোদ - প্রমোনও ছিল তেমনি জঘন্য। তিনি সম্পট ও দুশ্চরি প্রকৃতির ছিলেন এবং মদ্যপানে নগ্ন থাকতেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই একটি করে নিয়ে যেতেন। ফলে ধর্মীয় নেতাগণ তাদের এরূপ অপমানে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বানরকে ধর্মীয় নেতার পোশাকে সজ্জিত করে সুন্দর বেশভূষায় মন্ডিত একটি শিল্পীয় গর্ব পৃষ্ঠে করে রাখতো।
ইমাম হুসাইন পিতার গুণাবলির ও বীরোচিত স্বভাবের উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, এবং ধর্মপরায়ণতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ঐতিহাসিক সেডিলট মন্তব্য করেন, তার মধ্যে একটিমাত্র গুণের অভাব ছিল তা হলো ষড়যন্ত্র ফাঁদবার কৌশল। উমাইয়া বংশধরগণ এ ব্যাপারে সিদ্যহস্ত ছিলেন। ইমাম হুসাইন ইয়াজিদের উত্তরাধিকারকে নীতিজ্ঞান বিবর্তিত ইসলামবিরোধী ‘বিদআত্’ (নব প্রবর্তিত প্রথা) জ্ঞানে প্রতিবাদ করলেন। খলিফা পদের জন্য ইয়াজিদের অযোগ্যতা ইসলাম ধর্মমতে হুসাইনকে অযোগ্য রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার দিয়েছিল। কাজেই মহানবীর দৌহিত্র পাপাচারী ইয়াজিদের স্বৈরাচারী খিলাফত দাবি অস্বীকার করেন। বস্তুত শতগুণে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। সকল দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সাইনই ছিলেন খিলাফতের ন্যায়সঙ্গত দাবিদার। হুসাইন - ইবন - আলীর এ ন্যায্য দাবিকে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুর রহমান - ইবনে আবু বকর সমর্থন করেন। অবশ্য কিছুদিন পরে শেষোক্ত দুই ব্যক্তি ইয়াজিদের প্রলোভনে পড়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর ইয়াজিদের কর্তৃত্ব সহ্য করতে না পেরে মক্কায় চলে যান। আব্দুল্লাহ হুসাইনকে যীয় পথ হতে অপসারিত করার জন্য নানাভাবে তাঁকে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন।
কিন্তু উমাইয়াদের শাসনে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং কুফার পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইমাম হুসাইনকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন সম্পাদনার কুফবাসী করে। তারা তাঁকেই খিলাফতে অধিষ্ঠিত করতে চায়।
ইতিমধ্যে ইরাকের শাসনকর্তা ওবায়দুল্লাহ - বিন - জিয়ান মুসলিমকে করে এবং তার রক্ষাকারীকে হত্যা করেন। এতে কুফাবাসারা ওবায়দুল্লাহর প্রাসাদ ঘেরাও করে নকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে দমন করা হয়। তীত কুফাবাসিগণ আর হুসাইনের সাহায্যার্থে অগ্রসর হতে সাহস কেউ প্রলোভনের লোভে ওবায়দুল পক্ষেই যোগ দিল। ইতোমধ্যেই মুসলিম প্রেরিত আশ্বাস আত্মীয় - এবং ২০০ অনুচরসহ ৬০ হিজরির শাবান মাসের শেষের দিকে পিতৃ রতয়ানা হলেন।
কারবালার হত্যাকাণ্ড ইসলাম জগতের সর্বত্র ত্রাসের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। এই ঘটনা খিলাফত ও তার ভাগ্যে লিপি নির্ধারন করে।এই মর্মন্তুদ ঘটনার পর হাশেমী ও উ।।মাইয়া বিরোধ আরো তীব্র আকার ধারণ করে।ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি – প্রথম পত্র মুসলিম জগৎ শিয়া সূন্ন নামে দুটি বিবদমান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে ঐতিহাসিক হিনি বলেন, ভুসাইনের রক্ত তাঁর পিতার রক্ত অপেক্ষাৎ বেশি করে শিয়া মতবাদ গঠনের কার্যকরী হৃদ প্রমাণিত হলো।
১০ ই মহররম শিয়া মতবাদের জন্মলাভ ঘটে। শিয়াদের মতে মুহাম্মদের (স) ইন্তেকালের পর ও হুসাইন মুসলিম জাহানের ন্যায়সঙ্গত ইমাম। তারা খুলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম তিনজন খলিফার খিলাফতকেও বৈধ বলে মানতে রাজি নন, অন্যদিকে সুন্নিগণ খুলাফায়ে রাশেদিনের ফিগানকে বৈধ মনে করেন। কিন্তু জালীর বংশধরদের প্রতি উমাইয়াগণের দুর্ব্যবহার সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে ইয়াজিদ অত্যাচারী ও পাপাত্মা হলেও প্রতিষ্ঠিত খলিফা। যাহোক, শিয়া সম্প্রদায় মহররমের প্রথম শদিন শোক দিবস হিসেবে পালন করেন। কারবালার যুদ্ধ শিয়া মুসলমানদেরকে যে এক যুদ্ধের আওয়াজ দান করেছে তা পরিণামে উমাইয়া বংশের পতন ত্বরান্বিত করে। এ যুদ্ধের বিষময় ফল এই যে, এটা শিয়া - সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করে ইসলামের ঐক্য ও সংহতি চিরতরে বিনষ্ট করেছে।
কারবালার নিষ্ঠুর ও জঘন্য হত্যাকাণ্ডে সমগ্র মুসলিম জাহান বিশেষ করে মক্কা ও মদিনার অধিবাসিগণ অত্যন্ত সমর্মাহত হয়ে পড়ে। তাঁরা ইয়াজিদের নিকট এই অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করলো। ফরসিগণও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। বসরাতে খারিজী দলও শক্তিশালী হয়ে উঠলো এবং তারাও প্রতিশোধ গ্রহণে বন্ধ, প্রতিক্রিয়া পরিকর হলো। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ - বিন - যুবাইরও খিলাফত দাবি করে বসেন। খলিফা ইয়াজিদ ইবনে যুবাইরকে দামেশকে আনার জন্য মারওয়ান ও তৎপুত্র আব্দুল মালিককে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান। যুবাইর ইয়াজিদের কুমতলব বুঝতে পেরে খলিফার দূত দুজনকে বন্দী করে রাখেন। মদিনাবাসিগণ বিক্ষুণ্ণ হয়ে উঠলো। তাঁরা ইয়াজিদের পদচ্যূতি ঘোষণা করে তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তাকে মদিনা করে দিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াজিদ সিরিয়ার বেতনভুক্ত সৈন্য এবং উমাইয়া বংশের বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ দ্বারা গঠিত বিরাট সৈন্যবাহিনীকে মুসলিম - ইবনে - উকবার নেতৃত্বে মদিনা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। ৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে আগস্ট হাররা নামক স্থানে দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলো। মদিনা বাসিগণ প্রতিপক্ষের সংখ্যাধিক্য হেতু শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। এই যুদ্ধে হযরতের বহু আনসার ও মুহাজির সাহাবিগণ প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বিজয়োল্লাসে উন্মত্ত ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী ৩ দিন ধরে মন্দিনায় লুণ্ঠনকার্য চালিয়ে মদিনাকে অপবিত্র করে।
খুলাফায়ে রাশেদিনের সময় নির্মিত মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ ইত্যাদি ইয়াজিদের বাহিনী বিনষ্ট করে দেয়। আমীর আলী বলেন, “যে শহর নবিকে আশ্রয় দান করেছিল এবং যা তাঁর জীবন নয় যারা পবিত্র হয়েছিল তা এক্ষণে জঘন্যভাবে অপমানিত হলো। নবির বিপদের সময় যারা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা এক্ষণে ন্যাক্কারজনক নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হলেন। ”
উপর এর প্রতিফল হলো নিষ্ঠুর, ভয়াবহ এবং বীভৎস। ইসলামের বিজয়ের মুহূর্তে উমাইয়াদের প্রতি যে সয়া এবং সহিভূতা দেখানো হয়েছিল এভাবে তারা তার প্রতিদান দিল। মাদিনাকে অপবিত্র ও ধ্বংস করে ইয়াজিদ বাহিনী মঞ্চাভিমুখে যাত্রা করে। মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইস। বালিকা বলে ঘোষণা করেছিলেন। পথিমধ্যে যাত্রাকালে সেনাপতি মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে হুসাইন - ইন শাখ নুমাইর সিরীয় বাহিনীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেপ্টেম্বর শত্রুপক্ষীয় সৈনারা মক্কা অবরোধ করে। অতঃপর যে যুদ্ধ সংঘটিত হল তাতে পবিত্র কা'বা এবং অন্যান্য সমীর প্রাসাদের সবিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের মৃত্যু হলে তার সৈন্যবাহিনী ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অবরোধ উঠিয়ে তুরিগাতিতে দামেকে প্রত্যাবর্তন করে। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “অবরোধের ফলে কার্য আগ্নি সংযোজিত হয়। পবিত্র কৃষ্ণলপ্তর ত্রিখণ্ডিত হয়ে যায়, কা'বা গৃহ রুদনরতা রমণীর ভগ্নহৃদয়ের রূপ লাভ করে।
অপরপক্ষে,
ইমাম হুসাইনের অবর্তমানে তিনি খলিফা হবার গোপন ইচ্ছা পোষণ করতেন। মক্কা ও মদিনার আলীর সমর্থকগণও ইমাম হুসাইনকে সমর্থন করেন। ফলে খিলাফতের দাবির প্রশ্নের ফয়সালার জন্য হুসাইন ও ইয়াজিদের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। কুফাবাসিগণ উমাইয়া শাসনের অভিশাপ হতে মুক্তিপাতের জন্য ইমাম হুসাইনের সাহায্য প্রার্থনা করলো। তারা হযরত আলীর আমলে সকল প্রকার সুযোগ - সুবিধা লাভ করেছিল।
কিন্তু উমাইয়াদের শাসনে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং কুফার পূর্বগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইমাম হুসাইনকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন সম্পাদনার কুফবাসী করে। তারা তাঁকেই খিলাফতে অধিষ্ঠিত করতে চায়।
ইমাম হুসাইন তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়া অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করলেন। উগ্রফতাব ও চপলমতি কুফাবাসীদের প্রতিশ্রুতিতে আশা সান না করার জন্য একমাত্র আব্দুল্লাহ ইবন - যুবাইর ছাড়া তাঁর অপরাপর সকল বন্ধু - বান্ধব তাঁকে পরামর্শ দেন। তাঁরা দিন হতে দিনান্তরে নিজেদের অন্তরের সন্ধান রাখতো না। কোনো ব্যক্তিবিশেষ অথবা উদ্দেশ্যের সমর্থনে বরফের এবং অন্যদিকে কুফাবাসীদের সকল ন্যায় শীতল ও মৃত ব্যক্তির ন্যায় গ্রহণ করলেন। তবুও যাত্রার পূর্বে ঐদ্বু উদাসীন হয়ে পড়তো। একদিকে আব্দুল্লাহ - ইবনে - যুবাইরের উৎসাহ ও প্ররোচনা করে এই মুহূর্তে জ্বলন্ত অগ্নিবৎ উত্তেজিত হয়ে উঠতো, আবার পরক্ষণেই এর আশ্বাস ও সাহায্যের উপর নির্ভর করে হুসাইন কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত কারকারী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম হুসাইন কৃষ্ণার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য তাঁর চাচাত ভাই মুসলিম দিন অতিশকে তথায় প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীদের কাছে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে একখানা পত্র লেখেন।
বিশেষত খিলাফতের সুমহান দারিত্ব হযরত মুহাম্মদের ইয়ার মতো একজন বিশ্বাসী, লম্পট ছিলেন না। কাজেই কুফাবাসীদের সাহায্যের উপর ভরসা করে ইয়াজিদের সাথে শক্তি পরীক্ষার জন্য হুসাইন মসিনা হতে কৃষ্ণা যাত্রা করলেন। প্রথম কুফার মরুভূমি অতিক্রম করার পর তিনি মুসলিমের হত্যার সংবাদ পেয়ে দুঃখিত হলেন। করার সময় ছিল, কিন্তু মুসলিমের আত্মীয় - স্বজন তাঁর রক্তের প্রতিশোধ নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। দি সম্মুখ দিকেই অগ্রসর হতে লাগলেন। কিন্তু ক্রমাগত দুঃসংবাদ আসতে লাগলো। নগরের অভ্যন্তরে হুসাইনের সহি থাকলেও তারা ওবায়দুল্লাহর ভয়ে বাইরে আসতে পারতো না।
নগরীর আন্তরিক সহানুভূতি তাঁর (হুসাইন) প্রতি কিন্তু এর তদারকি তাঁর গোত্রপতি তাঁকে গতি পরিবর্তন করে আড্ডা ও সালমা পাহাড়ে আশ্রয় নিতে উপদেশ দিলেন এবং আনাসেন, সেখানে সপ্তাহকালের মধ্যে ২০,০০০ বনি ভারী তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু হতাশ হুসাইন আর যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি সম্মুখ দিকে যাওয়াই স্থির করলেন। কিন্তু কিছুদূর আসর হতেই তাহ গোত্রের আলহোর নামক এক আরব প্রধানের পরিচালনায় কুফার অশ্বারোহী বাহিনী তার গতিরোধ করলো (হিজরী ৮ ই ৬০ / ১০ সেপ্টেম্বর, ৬৮০) ডানে কুফাকে রেখে দলটিসহ হুসাইন ফোরাত নদীর পশ্চিম উপকূল ধরে অগ্রসর হতে লাগলেন। ওবায়দুল্লাহ তার অধীনশ সেনাপতি ওমর ইবনে সালের অধীনে ৪,০০০ সৈন্য প্রেরণ করে । সৈন্য দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে হুসাইন ১লা মহররম কুফার মাইল উত্তরে ফোরাত তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে বাধ্য হয়ে শিবির স্থাপন করলেন। শিবির স্থাপন इला ই কারবালায় অ কুফা বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইনকে ইয়াজিদের নামে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতে নির্দেশ দিে বীরহৃদয় হুসাইন তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে কুফার সৈন্যগণ ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দণ্ডায়মান হলো এক হুসাইন শিবিরের পানি সপ্তাহের পথ বন্ধ করে দিল। এরূপ মুরবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি শান্তি প্রস্তাবের যে কোনো একটি গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে পাঠালেন-
১. তাঁকে হয় মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক, না হয়
ওবায়দুল্লাহ এ আবেদন মেনে নিতে রাজি ছিল, কিন্তু খ্যাতিলাভের জন্য সীমারের প্ররোচনার সে হুসাইনকে জীবিত অথবা তাঁর মৃতদেহ কুফায় নিয়ে যেতে আদেশ দিল ৮ ই মহররম, পানির অভাবে হুসাইন - শিবিরে হাহাকার পড়ে গেল। ছোট ছোট শিশু ও বালক - বালিকাগণ মূর্ছিত হয়ে পড়ল। এভাবে অবর্ণনীয় দুঃখ - কষ্টের মধ্যে তিন দিন কেটে গেল। নিরুপায় হয়ে শেষবারের মতো হুসাইন উমাইয়া পাৰণ্ডদের নিকট অনুরোধ জানালেন যেন অসহায় স্ত্রীলোক ও বালক - বালিকাদের সাথে যুদ্ধ না করা হয় এবং শুধু তাঁর প্রাগ ১লা মহররম হুসাইন সংহার দ্বারাই যেন এ অসম দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। উমাইয়াগণ মায়া - মমতার কোনো ধার ধারক না। অবশেষে ইমাম হুসাইন বান্দবগণকে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু মৃত্যু স্বীকার করেও তারা কেউই প্রিয় ইমামের সঙ্গ পরিহার করতে রাজি হলেন না। শত্রুপক্ষের সেনাপতি দুর সবির সৌহিত্রের বিরুদ্ধে অসাধারণ অত্যন্ত পাপের কাজ মনে করে তাঁর ৩০ জন অনুচরসহ হুয়াইলে যোগদান সেদিন ছিল স্টাব্দের ১০ অক্টোবর। কারবারী ও শিশুর আর্তনাদের মধ্যেই দুই অসম দুগ্ধ শুরু হলো। প্রত্যেকটি চুসাইনের বাহিনীর অঙ্গে ছিল । কিন্তু নগণ্য সৈন্যের শৌর্য - বীর্য তাদেরকে বিপর্যয়ের হাত হতে রক্ষা করতে পারলো না । হুসাইনের আনুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদৎ বরণ করেন । প্রচন্ড সংঘর্ষে একে একে প্রায় সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হতে লাগলো। মহাবীর হুসাইন বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষের অনেককেই শাধিত করলেন। অবশেষে তৃষ্ণাত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে আসর হলেন এবং পানি পান করাতে উদ্যত হলেন। কিন্তু দুশমনের আকস্মিক নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে শিশুপুর পিতার অনুকমনে শহীদ হলো। একাকী অবসন্ন অবস্থায় দয়ামায়াহীন শত্রুর মুকাবিলা করতে অসমর্থ হয়ে তিনি ভাবুর সামনে বসে পড়লেন। এমন সময় জনৈকা মহিলা তাঁর হাতে এক পেয়ালা পানি এনে দিল। তিনি পানি পান করতে উলাত হলে দুশমনের নিক্ষিপ্ত একটি বাণে তাঁর মুখ বিদীর্ণ হয়ে গেল।
২. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক,
অথবা
৩. ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেকে প্রেরণ করা হোক। ঐতিহাসিক মুইর বলেন, “এ অনুরোধ রক্ষা করা হলে উমাইয়াদের মঙ্গলই হতো।”
এমতাবস্থায় জীবিত ও মৃত ব্যক্তিদের জন্য চুসাইনের সরক আল্লাহর দরবারে মঙ্গল কামনা করে ইমাম হুসাইন শেষবারের মতো মরিয়া হয়ে উমাইয়াদের ১০ই মহররম উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। শত্রুরা ভীত হয়ে পালাতে লাগলো কিন্তু রক্তপাতে মূর্ছিত হয়ে তিনি হিট ১০ ই অক্টোবর শীঘ্রই ভূতলশায়ী হলেন । ঘাতক সীমার তাঁর তক ছিন্ন ক্যালো, মৃতদেহ পদদলিত করলো এবং বর্বরতার সাথে এর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করলো (১০ ই অক্টোবর, ৮০ খ্রি.)। তাঁর মস্তক কুফার দূর্গে নিয়ে গেলে নৃশংস ওবায়দুল্লাহ এর মুখমণ্ডলে বেত্রাঘাত করলো। এটা দেখে একজন বৃদ্ধ মুসলমান চিৎকার করে ফললেন, “আফসোস , আমি এই ওষ্ঠদ্বয়ের উপর আল্লাহর রসুলের ওষ্ঠদ্বয় সম্বোপিত হতে দেখেছি ”। এই ভয়াবহ দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো। এর পরবর্তী করুণ দৃশ্য জগতের প্রতিটি মুমিন - মুসলমানের হৃদয়ে আজও জাগরুক রয়েছে। ঐতিহাসিক গীবন বলেন, একমাত্র হুসাইনের বা পুত্র জয়নুল আবেদীন (ধার্মিকজনের অলঙ্কার) ব্যতীত হুসাইন পরিবারের সকল পুরুষই শাহাদৎ বরণ করেছিলেন। হুসাইন পরিবারের মহিলাদেরকে ছোট তরুণবয়স্ক আলীর সাথে দামেশকে ইয়াজিদের নিকট প্রেরণ করা হলো। তাঁদের পথপ্রদর্শক সৈন্যদল ৭০ জন শহীদের (আসলে হুসাইন ৩০ জন অশ্বারোহী এবং ৪০ জন পদাতিক বাহিনী নিয়ে উমাইয়াগণের সাথে কারবালায় লড়াই করেছিলেন) ছিন্ন মস্তক বর্শাফলকে বিশ্ব করে নিয়ে চলল। দামেস্কে হাজির হলে তাঁদের সেই শোকপূর্ণ ব্রুন্দনে ইয়াজিদ ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি হুসাইনের তন্নী জয়নাব ও পুত্র জয়নুল আবেদীনের নিকট হুসাইনের পবিত্র মস্তক প্রত্যর্পণ করেন। তাঁরা তাঁর পবিত্র দেহ মস্তকসহ কারবালায় সমাধিস্থ করেন।
হুসাইন পরিবারের জীবিত মহিলারা শিশু আলীসহ মদিনায় চলে যান। সত্য, ন্যায় ও ইসলামী রাষ্ট্রনীতির জন্য কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইনের করুণতম মৃত্যু সারা বিশ্বের কাছে এক মহাশিক্ষার উৎসরূপে চিরকাল প্রেরণা যোগাবে। ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করলেই তিনি নিজের এবং আত্মীয় - স্বজনের জীবন রক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তাঁর মহান আদর্শ ও নীতিতে হিমাদ্রির মতো অবিচল ও অটল থেকে সত্যের জন্য জান কুরবানী করে দুনিয়ার বুকে এক মহান আদর্শ রেখে গেছেন।
কারবালার যুদ্ধের গুরুত্ব
কারবালার হত্যাকাণ্ড ইসলাম জগতের সর্বত্র ত্রাসের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। এই ঘটনা খিলাফত ও তার ভাগ্যে লিপি নির্ধারন করে।এই মর্মন্তুদ ঘটনার পর হাশেমী ও উ।।মাইয়া বিরোধ আরো তীব্র আকার ধারণ করে।ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি – প্রথম পত্র মুসলিম জগৎ শিয়া সূন্ন নামে দুটি বিবদমান দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে ঐতিহাসিক হিনি বলেন, ভুসাইনের রক্ত তাঁর পিতার রক্ত অপেক্ষাৎ বেশি করে শিয়া মতবাদ গঠনের কার্যকরী হৃদ প্রমাণিত হলো।
১০ ই মহররম শিয়া মতবাদের জন্মলাভ ঘটে। শিয়াদের মতে মুহাম্মদের (স) ইন্তেকালের পর ও হুসাইন মুসলিম জাহানের ন্যায়সঙ্গত ইমাম। তারা খুলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম তিনজন খলিফার খিলাফতকেও বৈধ বলে মানতে রাজি নন, অন্যদিকে সুন্নিগণ খুলাফায়ে রাশেদিনের ফিগানকে বৈধ মনে করেন। কিন্তু জালীর বংশধরদের প্রতি উমাইয়াগণের দুর্ব্যবহার সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে ইয়াজিদ অত্যাচারী ও পাপাত্মা হলেও প্রতিষ্ঠিত খলিফা। যাহোক, শিয়া সম্প্রদায় মহররমের প্রথম শদিন শোক দিবস হিসেবে পালন করেন। কারবালার যুদ্ধ শিয়া মুসলমানদেরকে যে এক যুদ্ধের আওয়াজ দান করেছে তা পরিণামে উমাইয়া বংশের পতন ত্বরান্বিত করে। এ যুদ্ধের বিষময় ফল এই যে, এটা শিয়া - সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করে ইসলামের ঐক্য ও সংহতি চিরতরে বিনষ্ট করেছে।
কারবালার নিষ্ঠুর ও জঘন্য হত্যাকাণ্ডে সমগ্র মুসলিম জাহান বিশেষ করে মক্কা ও মদিনার অধিবাসিগণ অত্যন্ত সমর্মাহত হয়ে পড়ে। তাঁরা ইয়াজিদের নিকট এই অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করলো। ফরসিগণও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। বসরাতে খারিজী দলও শক্তিশালী হয়ে উঠলো এবং তারাও প্রতিশোধ গ্রহণে বন্ধ, প্রতিক্রিয়া পরিকর হলো। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ - বিন - যুবাইরও খিলাফত দাবি করে বসেন। খলিফা ইয়াজিদ ইবনে যুবাইরকে দামেশকে আনার জন্য মারওয়ান ও তৎপুত্র আব্দুল মালিককে দূত হিসেবে মক্কায় পাঠান। যুবাইর ইয়াজিদের কুমতলব বুঝতে পেরে খলিফার দূত দুজনকে বন্দী করে রাখেন। মদিনাবাসিগণ বিক্ষুণ্ণ হয়ে উঠলো। তাঁরা ইয়াজিদের পদচ্যূতি ঘোষণা করে তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তাকে মদিনা করে দিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ইয়াজিদ সিরিয়ার বেতনভুক্ত সৈন্য এবং উমাইয়া বংশের বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ দ্বারা গঠিত বিরাট সৈন্যবাহিনীকে মুসলিম - ইবনে - উকবার নেতৃত্বে মদিনা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। ৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে আগস্ট হাররা নামক স্থানে দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলো। মদিনা বাসিগণ প্রতিপক্ষের সংখ্যাধিক্য হেতু শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। এই যুদ্ধে হযরতের বহু আনসার ও মুহাজির সাহাবিগণ প্রাণ বিসর্জন দিলেন। বিজয়োল্লাসে উন্মত্ত ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী ৩ দিন ধরে মন্দিনায় লুণ্ঠনকার্য চালিয়ে মদিনাকে অপবিত্র করে।
খুলাফায়ে রাশেদিনের সময় নির্মিত মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ ইত্যাদি ইয়াজিদের বাহিনী বিনষ্ট করে দেয়। আমীর আলী বলেন, “যে শহর নবিকে আশ্রয় দান করেছিল এবং যা তাঁর জীবন নয় যারা পবিত্র হয়েছিল তা এক্ষণে জঘন্যভাবে অপমানিত হলো। নবির বিপদের সময় যারা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা এক্ষণে ন্যাক্কারজনক নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হলেন। ”
উপর এর প্রতিফল হলো নিষ্ঠুর, ভয়াবহ এবং বীভৎস। ইসলামের বিজয়ের মুহূর্তে উমাইয়াদের প্রতি যে সয়া এবং সহিভূতা দেখানো হয়েছিল এভাবে তারা তার প্রতিদান দিল। মাদিনাকে অপবিত্র ও ধ্বংস করে ইয়াজিদ বাহিনী মঞ্চাভিমুখে যাত্রা করে। মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইস। বালিকা বলে ঘোষণা করেছিলেন। পথিমধ্যে যাত্রাকালে সেনাপতি মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে হুসাইন - ইন শাখ নুমাইর সিরীয় বাহিনীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন। ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেপ্টেম্বর শত্রুপক্ষীয় সৈনারা মক্কা অবরোধ করে। অতঃপর যে যুদ্ধ সংঘটিত হল তাতে পবিত্র কা'বা এবং অন্যান্য সমীর প্রাসাদের সবিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের মৃত্যু হলে তার সৈন্যবাহিনী ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অবরোধ উঠিয়ে তুরিগাতিতে দামেকে প্রত্যাবর্তন করে। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “অবরোধের ফলে কার্য আগ্নি সংযোজিত হয়। পবিত্র কৃষ্ণলপ্তর ত্রিখণ্ডিত হয়ে যায়, কা'বা গৃহ রুদনরতা রমণীর ভগ্নহৃদয়ের রূপ লাভ করে।