তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের ইতিহাস

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মত স্বাভাবিক তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের ঘটনাও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক। এই ঘটনার গবেষণালব্ধ জ্ঞান পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। যেমনঃ ভেলক্লিয়তা ও ভোস্ক্রিয় স্বপ্ন সূত্র

 ১। এক মৌল থেকে অন্য মৌল সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং 
 ২। নিউক্লিয় শক্তি নামে এক নতুন ধরনের শক্তির ভান্ডার মানুষের কাছে উন্মোচিত করেছে আবিষ্কারের ফলে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন এই শাখা বিশেষভাবে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। 

তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের ঐতিহাসিক পটভূমি


X- রশ্মি আবিষ্কৃত হয় 1895 খ্রিস্টাব্দে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন X- রশ্মি উৎপাদনকারী তড়ি ক্ষণের নলের ঠিক যে স্থানটি থেকে X- রশ্মি নির্গত হয়, সেই স্থানটিতে সবুজাত হলুদ বর্ণের প্রতিহত্য সৃষ্টি হয়। 1896 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেল বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হন। ইউরেনিয়ামের একটি যৌগ পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট সেই সময় প্রতিভা বস্তু বলে জানা ছিল। বেকরেল অনুমান X- রশ্মির অস্বাভাবিক নয়। বেকরেল থেকেও কালো মতো অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হওয়া করেন, এই এই লবণের একটি টুকরো কাগজে মোড়া একটি ফোটোগ্রাফিক প্লেটের উপর রেখে প্লেটটি সূর্যালোকে রেখে দেন এবং পরে লক্ষ করেন ফোটোগ্রাফিক প্লেটের যে অংশে লবণের টুকরোটি রাখা হয়েছিল সেই অংশে টুকরোটির অবিবল কালো ছাপ পড়েছে। এর থেকে বেকরেল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সূর্যালোকে রেখে দেওয়ার ফলে ইউরেনিয়াম যৌগটি থেকে ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন এক প্রকার অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয়, কারণ কালো কাগজের মধ্যে দিয়ে সাধারণ দৃশ্যমান আলো যেতে পারে না।

এই পরীক্ষা চলাকালীন প্যারিসের (Paris) আকাশ কয়েক দিন মেঘলা থাকায় বেকরেলের পরীক্ষায় বাধা সৃষ্টি হয়। তিনি পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেটের টুকরোটি কালো কাগজে মোড়া ফোটোগ্রাফিক প্লেটের উপর চাপা দিয়ে তার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দেন। কয়েক দিন পর ড্রয়ার থেকে ফোটোগ্রাফিক প্লেটটি বের করে এনে দেখেন, প্লেটের যে স্থানে লবণের টুকরোটি বসানো ছিল সেই স্থানটি কালো হয়ে গেছে। ইউরেনিয়াম লবণ এবং ফোটোগ্রাফিক প্লেটকে অ্যালুমিনিয়াম বা কপার ধাতুর খুব পাতলা পাতের সাহায্যে পৃথক পৃথক করে রাখলেও প্লেটটি অন্ধকার স্থানে একইভাবে আক্রান্ত হয়।

এই সব পরীক্ষার পর্যবেক্ষণ থেকে বেকরেল অনুধাবন করেন যে, ইউরেনিয়াম লবণ থেকে নিঃসৃত রশ্মির সঙ্গে সাধারণ প্রতিপ্রভার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, প্রতিপ্রতা আলোকের অনুপস্থিতিতে প্রকাশ পায় না, কিন্তু এই রশি বিকিরণ আলো এবং অন্ধকারে সমভাবেই চলতে থাকে। সুতরাং তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পটাশিয়াম ইউরেনাইল সালফেট থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক ধরনের অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয়, যা কালো কাগজ বা পাতলা ধাতব পাতের মধ্যে দিয়ে সহজে অতিক্রম করে, ফোটোগ্রাফিক প্লেটকে আক্রমণ করে এবং এই রশ্মি নির্গমন অবিরাম চলতে থাকে, কোন অবস্থাতেই বন্ধ হয় না। মাদাম কুরি (Madam Curie) এই অদৃশ্য রশ্মি বিকিরণের ঘটনার নাম দেন তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity)

মাদাম কুরি ও তার তেজক্রিয়তা সংক্রান্ত গবেষণা


1898 খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী মাদাম কুরি তাঁর স্বামী পিয়ার কুরির (Pierre Curic) সহযোগিতা তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন। তারা ইউরেনিয়ামের একটি খনিজ (Pitchblende) নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, এই যৌগের মধ্যে যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম বর্তমান এবং তার জন্য যৌগটির তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ যা হওয়ার কথা, প্রকৃতপক্ষে যৌগটির তেজস্ক্রিয়তা তার অনেক বেশি। এই পর্যবেক্ষণ থেকে কুরি দম্পতি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, পিচব্লেন্ড এ ইউরেনিয়াম যে সব আলোর সামনে ধরলে বস্তুগুলো থেকে এক প্রকার আলোক বিচ্ছুরিত হয়, তাদের প্রতিপ্রভা বস্তু বলে।

ইউরেনিয়াম ছাড়াও অন্য কোন তেজস্ক্রিয় মৌল উপস্থিত আছে যার তেজস্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। অসীম ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে কাজ করে তারা কয়েক টন পিচপ্লেন্ড থেকে খুব সামান্য পরিমাণ একটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল পৃথক করতে সমর্থ হন। বিজ্ঞানের জগতে এক প্রতিভাময়ী বিদূষী মহিলার আবির্ভাব ও তার মাতৃভূমি পোল্যান্ডকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই নতুন মৌলটির নাম দেওয়া হল। পোলোনিয়াম (Polonium)। এই আবিষ্কারের বছর খানেকের মধ্যে কুরি দম্পতি পিচব্লেন্ড থেকে আরও একটি তেজস্ক্রিয় মৌল পৃথক করেন। 

অতি উচ্চ বিকিরণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই মৌলটির নাম দেওয়া হয় রেডিয়াম (Radium)। মাদাম কুরি 1903 খ্রিস্টাব্দে তার স্বামী পিয়ের কুরি এবং হেনরি বেকারেলের সঙ্গে এক সাথে তেজস্ক্রিয়তার উপর গবেষণার জন্য পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম মৌল আবিষ্কারের জন্য 1911 খ্রিস্টাব্দে মাদাম কুরি একাই রসায়নের নোবেল পুরস্কার পান।

কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার এর কাহিনী


1934 খ্রিস্টাব্দে আইরিন কুরি (মাদাম কুরির কন্যা) এবং তাঁর স্বামী ফ্রেডারিক জোলিও (I. Curie) লক্ষ করেন যে কয়েকটি হালকা মৌল অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বোরন ইত্যাদিকে আলফা - কণা দ্বারা আঘাত করলে দু - ধরনের বিভাজন হতে দেখা যায়। প্রথম ধরনের (পঞ্জিটিভ চার্জযুক্ত ইলেকট্রন) নির্গত হয়। আলফা - কণা দ্বারা আঘাত বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রোটন ও নিউট্রন নির্গমন বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু প্রজিট্রন নির্গমন চলতে থাকে- তবে এই নির্গমনের হার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে।

এই ঘটনা লক্ষ্য করে আইরিন এবং ফ্রেডারিক এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, আলফা - কণার আঘাতে প্রথমে আঘাতপ্রাপ্ত নিউক্লিয়াস (target necleus) থেকে নিউট্রন কণা বেরিয়ে আসে। এর ফলে যে নতুন মৌলটি উৎপন্ন হয় সেটি তেজস্ক্রিয় হয় এবং এই নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে পজিট্রন নির্গত হতে থাকে। যেমন: ম্যাগনেশিয়াম, নিউক্লিয়াসকে আলফা কণা দ্বারা আঘাত করলে তেজস্ক্রিয় সিলিকন (রেডিও -সিলিকন) উৎপন্ন হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রন কণা নির্গত হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url