গুণগত শিক্ষা | Quality education

শিক্ষা প্রসঙ্গে সুপ্রচলিত প্রবাদ, 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড'। অর্থাৎ, মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন দেহ চলে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া দেশ চলে না। জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতির জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে ব্যাপকভাবে। সরকার জাতীয় বাজেটে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এত কিছুর পরেও শিক্ষার সুফল নিয়ে সর্বত্র একটা আশঙ্কা বিরাজ করছে। অনেক বিজ্ঞজনই মনে করেন, সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষা গুণগত মানে উৎকর্ষ হারানোর কারণে।
গুণগত শিক্ষা


গুণগত শিক্ষা কী?


যে শিক্ষা মানুষের সুপ্তশক্তির উদ্বোধন ঘটায়, মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে সৃজনশীলতা, মানুষকে করে তোলে কর্মদক্ষ, সর্বোপরি মানুষকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করে সেই শিক্ষাই গুণগত শিক্ষা হিসেবে পরিগণিত। শিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটলেই সেই শিক্ষাকে গুণগত শিক্ষার অভিধা দেওয়া সম্ভব। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে সদর্পে বদলে দেওয়া, গুণগতভাবে মানুষকে উন্নত ও বিকশিত করা। যে শিক্ষা তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়, তাকে কোনোভাবেই গুণগত শিক্ষা বলা যায় না। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হচ্ছে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা সার্টিফিকেট প্রদান ও গ্রহণের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে গেছে, শিক্ষা হয়ে গেছে বাণিজ্য পণ্য।

শিক্ষার বর্তমান অবস্থা


ডিগ্রি অর্জনের অন্ধ মোহে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষ্য নেই- না মানসিক ও আত্মিক উন্নয়নের, না পেশা বাছাইয়ের। অবস্থা অনেকটা এমন যে, ভাসতে ভাসতে কোনোখানে গিয়ে ঠেকলেই হলো। ফলত শিক্ষা হয়ে গেছে সমাজে মূল্যবোধহীন বেকার জনগোষ্ঠী তৈরির একটি মেগা প্রকল্প। কর্মসংস্থানের সুবিধা এদেশে অনেক সংকুচিত; শিক্ষাজীবন শেষে বেকার হওয়ার উদ্বেগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন কাটে । পড়াশোনার কঠিন সাধনার বদলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধাবিত হয় সহজ কোনো প্রতিষ্ঠার দিকে। অনেক শিক্ষার্থী জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় রাজনীতিকে। এ রাজনীতি নীতি-বিবর্জিত, একান্তই স্বার্থ-তাড়িত। এই রাজনীতিতে সন্ত্রাস আসে অনিবার্য নিয়মে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষার যোগ থাকে না। পরীক্ষায় পাশ করার সহজ উপায় হিসেবে নকল বাড়ে: আর নকল হলো সংক্রামক ব্যাধির মতো। একজন নকল করলে পাশেরজন উৎসাহিত হয়। নকলের মতো ঘৃণ্য অপরাধ বহুল চর্চায় বৈধতা পায়। নকল বাড়লে মেধা কমে। এভাবে কলুষিত হয় শিক্ষা, কলুষিত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে ব্যক্তিত্ব হারায় শিক্ষার্থীরা। সস্তা পথে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠা পেলেও অধিকাংশই হারিয়ে যায়। এভাবেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকে আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে এক গভীর সংকট, সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে শিক্ষা হলো চাকুরি নামক সোনার হরিণ শিকারের কলাকৌশল। যার ভাণ্ডারে যতবেশি তৃণ থাকবে, শিকার করার প্রতিযোগিতায় সে ততবেশি এগিয়ে থাকবে। তাই আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের একটা অসম্ভব চাপ ও তাড়ার মধ্যে থাকতে হয়। স্কুলে সিলেবাস ভারি করা হয়েছে, বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে, নতুন নতুন বিষয় যোগ হয়েছে, পরীক্ষার চাপ বেড়েছে। শিক্ষার ভয়াবহ মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের খুবই অভাব, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকও নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেক বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা নেই। এই চাপের সমাধান হিসেবে এসেছে কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউশনি আর গাইড বই। অভিভাবকের বেড়েছে ব্যয়ের বোঝা। আর ঘন ঘন পরীক্ষার চাপ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ছোটাছুটি করতে হয় গাইড বই, স্কুল, কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউটর, নোট ইত্যাদির মধ্যেই। সন্তানদের কাছে অভিভাবকদের দাবি বাইরের বই পড়বে না, ফার্স্ট হতে হবে, লেখাপড়া করে বড় লোক অর্থাৎ অনেক অর্থের মালিক হতে হবে, অনেক ক্ষমতাশালী হতে হবে। ফলত আমাদের শিক্ষার্থীরা চিন্তাশূনা, বিশ্লেষণশূন্য, প্রশ্নশূন্য ও আত্মকেন্দ্রিক একেকটি রোবট-মানবে পরিণত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিষিদ্ধ অথবা উপেক্ষিত। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। পার্শ প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা পারতপক্ষে সেদিকে ভিড়ে না। বাংলাদেশে কিছু ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় খুবই নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ও তদারকির মধ্যে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামোবদ্ধ পরিবেশে স্বতঃস্ফূর্ত তারুণ্যের বিকাশ অসম্ভব।

শিক্ষার মানের অবনতির কারণ


শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে সমন্বিত পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ব্যক্তি-স্বার্থে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনহীন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যেগুলো সুষ্ঠু শিক্ষা বিস্তারে শুধু অন্তরায়ই নয়, শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ ধ্বংসেরও কারণ। শিক্ষার উন্নয়নে মেধাবী শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকতাকে মেধাবীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র। শিক্ষকদেরকে এখানে করুণার দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা কাজ করে। মেধাবীরা তাই শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ থাকলেও অধিকতর সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার প্রত্যাশায় অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নেয়। যারা আবেগের বশে শিক্ষকতায় আসে নানা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে ক্রমান্বয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলত তাদের মেধার অনেক সময় অপচয়ই হয়। অথচ উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকতাকেই সবচেয়ে মর্যাদার কাজ বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই জীবন-জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতায় আসে, শিক্ষার প্রতি হয়তো তারা অন্তরের টান অনুভব করে না। শিক্ষাকে তারা পণ্য বানিয়ে নিজের ভাগ্যোন্নয়নে কাজে লাগায় তাদের আকর্ষণ শ্রেণিকক্ষের চেয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত কোচিং সেন্টারেই বেশি কেন্দ্রীভূত থাকে। তদুপরি শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংকট চরমে। নেই কোনো উন্নত লাইব্রেরি, মান-সম্মত গবেষণাগার। আমাদের দেশে যুগোপযোগী উত্তম পাঠ্যপুস্তকের মারাত্মক অভাব রয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে পাইড বই আর শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং সেন্টার বেশি আকর্ষণীয়। কারণ তারা চায় রুম পড়ে ভাল ফলাফল করার সহজ দাওয়াই। নকলের প্রবণতাও একই কারণে মারাত্মক পর্যায়ে আছে। শিক্ষার্থীদের সামনে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট আশ্বাস নেই। হতাশার মধ্যে উদ্যমী হওয়ার মানসিক শক্তি অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই থাকে না। এসব কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার মান কার্যত নিম্নমুখী।

গুণগত শিক্ষার মান ভালো করার উপায়


শিক্ষা এমন একটি বহুমাত্রিক বিষয়, যার সঙ্গে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যবই, শিক্ষার ব্যবস্থাপনা সরাসরি জড়িত। এর কোন একটিতে দুর্বলতা বা ত্রুটি থাকলে শিক্ষার মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করতে চাইলে প্রথমেই এদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য দরকার-

১. শিক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে মনোযোগী করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. পাঠ্যবইকে আকর্ষণীয় ও যুগোপযোগী করতে হবে।

৩. পর্যাপ্ত শিক্ষা-উপকরণ শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।

৪. আধুনিক পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার ও কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৫. গুণগত শিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় টেনে আনা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এজন্য শিক্ষকতাকে সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় করতে হবে। প্রাণ ছাড়া যেমন সুন্দর দেহ মূল্যহীন, তেমনি ভাল শিক্ষক ছাড়া গুণগত শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব কল্পনা।

৬. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। কোচিং সেন্টার, গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৭. যুগোপযোগী, বাস্তবসম্মত ও জীবনঘনিষ্ঠ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।

৮. দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের জন্য দেশে বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. পরীক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে শিক্ষকের দক্ষতার মূল্য প্রশ্নাতীত। সকল ক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষক দ্বারা মানসম্পন্ন প্রশ্ন প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে। পরীক্ষা থেকে নকল উচ্ছেদ করতে হবে।

১০. শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়। কারণ উদ্দেশ্য পরিষ্কার না থাকলে অর্জনের পথটি ঝাপসা হতে বাধ্য।

উপসংহার


২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে শামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই মহৎ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত, উন্নত মূল্যবোধলালিত সৃজনশীল জনশক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলেই স্বপ্ন পূরণের পথে বহুদূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, বাস্তবে রূপ পাবে স্বপ্নের 'সোনার বাংলা'।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url