চেরনোবিল দুর্ঘটনা কি? Chernobyl disaster

চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূর্ঘটনা পরিবেশের উপর অসাবধানী মানুষের একটা বিরাট আঘাত। চেরনোবিল কথায় আমাদের মনে নানা প্রশ্ন আসে। চেরনোবিল হল ইউক্রেনের একটি শহর। ইউক্রেন আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল যা এখন স্বাধীন দেশ। 

১৯৮৬ সালের ২৬ শে এপ্রিল ইউক্রেনের চের্নোবিল শহরে স্থাপিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটি ও মানুষের অসাবধানতার ফলে যে বিস্ফোরণ, ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে, আধুনিক মানুষের ইতিহাসে তা চেরনোবিল দুর্ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। চেরনোবিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম মৌল ব্যবহার করা হত।

এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দূর্ঘটনার দিন ঐ বন্দোবস্তোগুলো চালু ছিল না ফলে পারমাণবিক চুল্লির ভিতর ইউরেনিয়াম জ্বালানী প্রচন্ড গরম হয়ে যায় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলে প্রায় ৩০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সাথে সাথে তেজস্ক্রিয়তার বিষে আক্রান্ত হয়। এবং কাছাকাছি ইউরোপের দেশগুলোতে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।

চেরনোবিল দূর্ঘটনার প্রভাব | Effect of chernobyl disaster

চেরনোবিল দূর্ঘটনায় মানুষ ও প্রকৃতির দারুন বিপর্যয় ঘটে। সময় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর এই দূর্ঘটনার প্রভাব পড়েছে।

মানুষের অর্ধ সামাজিক পরিবেশের উপর প্রভাব

১. ব্যাপক অগ্নিকান্ড পারমাণবিক চুল্লির ভিতরে বিস্ফোরণের সাথে সাথে চতুর্দিকে আগুন ধরে যায়। এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় দশ দিন সময় লাগে। বহু মানুষ আগুনে ঝলসে মারা যায়। মনে রাখা দরকার যে, পরমাণু বোমা ফাটলে ঠিক এভাবেই ব্যাপক এলাকা জুড়ে মুহূর্তে আগুন লাগে।

২. জীবন ও স্বাস্থ্যহানি— বিস্ফোরণের ফলে নির্গত আয়োডিন -১৩১, সিজিয়াম -১৩৭ প্রভৃতি উপাদানের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে চের্নোবিলের আশেপাশে ৩১ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২০৯ জন কর্মী গুরুত্বর অসুস্থ হন ও প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পুনর্বাসন দিতে হয়।

৩. রুজি - রোজগারের উপর প্রভাব— চেরনোবিল দূর্ঘটনার জন্য বহু চাষীকে তার জমি থেকে, শ্রমিককে তার কল - কারখানা থেকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে সরকারি সাহায্য পেলেও এই দূর্ঘটনা তাদের অর্থনৈতিক ভাবেও পঙ্গু করেছে।

৪. পারমাণবিক শক্তির উপর মানুষের আস্থাহানি – চেরনোবিল দূর্ঘটনার আগে পর্যন্ত মানুষের মনে হয়েছিল। যে, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য পারমাণবিক শক্তির উপর নির্ভর করা যায়। এই দূর্ঘটনা সেই বিশ্বাসের ভিতকে নষ্ট করেছে।

৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা - চেরনোবিল দূর্ঘটনার অশুভ প্রভাব ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পূর্বতন সোভিয়েত সরকারকে বিস্তর সমালোচনা মুখোমুখী হতে হয়।

প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রভাব

১. বায়ু দূষণ— দূর্ঘটনার ফলে নির্গত আলফা, বিটা, গামা প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় রশ্মি, দাহ্য গ্যাস, ধোয়া ও উত্তপ্ত বাষ্প বায়ুমণ্ডল দূষিত করেছে।
২. পানি ও ভূমি দূষণ— তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলির কিছুটা বৃষ্টির জলের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার ফলে জল ও মাটি দূষিত হয়েছে।
৩. উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে দুষণ – তেজস্ক্রিয় পদার্থে জল ও মাটি বিষাক্ত হওয়ার ফলে, তা উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে সংক্রমিত হয়েছে। কারণ গরুর দুধের মধ্যে আয়োডিন -১৩১ মৌল খুঁজে পাওয়া গেছে।
৪. পরিবেশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ— চেরনোবিল দূর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য “রাষ্ট্রসঙ্গের সায়েন্টিফিক কমিটি অন এফেক্টস্ অফ অ্যাটমিক রেডয়েশন (UN Scientific Committee on Effects of Atomic Radiation) ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে সমীক্ষা চালান। এই সমীক্ষার ফলে দেখা যায় যে, ১৯৮৬ সালে বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া ও গ্রীসে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের পরিমাণ ছিল ০.৬-০.৮ মিলিসিয়েভার্ট ও সুইজারল্যান্ড এবং রোমানিযাতে ২.০০ মিলিসিয়েভার্ট। বস্তুত বিকিরণের এই মাত্রা যে অত্যন্ত বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চেরনোবিল দুর্ঘটনা হতে মানুষের শিক্ষা 

চেরনোবিল দূর্ঘটনা আমাদের বেশ কয়েকটি সাবধান করে দিয়েছে। সেগুলি হল:

১. পারমাণবিক শক্তি পরিবেশের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন নয় পারমাণবিক শক্তি থেকে সপ্তায় প্রচুর বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও, এই শক্তি কোনভাবেই পৃথিবীর পরিবেশের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন নয়। যান্ত্রিক গোলযোগ বা মানুষের কর্তব্য অবহেলা, যে কারণেই হোক না কেন, আণবিক চুল্লিতে যদি বিস্ফোরণ ঘটে তা হলে সেই দেশের ও প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাদের শরীর স্বাস্থ্য, বনসম্পদের ক্ষতি হতে পারে।
২. ভবিষ্যতে আরও দুর্ঘটনার আশংকা চেরনোবিল দূর্ঘটনার প্রভাব যদিও এক মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে অন্য কোন জায়গায় হয়তো এত অল্প সময়ে দুর্ঘটনার অশুভ প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বাড়বে।

৩. নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা – পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের সময়ে পরিবেশ আইন এবং অন্যান্য নিযন্ত্রণবিধি আরো কঠোরভাবে মানতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বা তার ধারেকাছে এই শক্তিকেন্দ্রগুলি কিছুতেই স্থাপন করা চলবে না।
৪. উন্নয়নশীল দেশগুলির বিপদ — মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চেনোবিলের চেয়ে বড় মাপের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ভবিষ্যতে হয়তো স্থাপন করার দরকার হবে। সে ক্ষেত্রে যদি ঐ দেশগুলি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর না হয়, তা হলে বিদেশ থেকে কেনা পুরানো প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা শক্তিকেন্দ্রগুলি দূর্ঘটনা প্রবণ হবে।

কারণ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকারী প্রযুক্তিবিদ্যা তাদের নেই বলে সব সময়ে বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। বিদেশী রাষ্ট্রের আরোপ করা বিধি - নিষেধ মেনে চলতে হবে। উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বিদেশী কোম্পানি ঠিক করে দেবে এবং জনগন শোষণের শিকার হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url