বাংলায় তুর্কি শাসন এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলায় তুর্কি শাসন শুরু করেন মূলত ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তুর্কি শাসন এলোমেলো হয়ে যায়। মূলত তুর্কি শাসকদের প্রত্যেকেই দিল্লি সুলতানাদের শাসক হিসেবে এসেছিলেন।
তারা দিল্লি সুলতানের দের সাথে যুদ্ধ করে আলাদা শাসনকার্য পরিচালনা করতে চেয়েছিল অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফলতা অর্জন করেছিল। তবে দিল্লি আক্রমণের এই সময় মুসলিম শাসন অনেকটা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছিল। এজন্য ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি এই সময়কে অর্থাৎ বাংলাদেশকে বুলাকপুর যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় বিদ্রোহের নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর তিনজন খলজির নাম জানা যায়। এরা নিজেদের মত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে বেশি দূর পর্যন্ত এগোতে পারেনি। মোহাম্মদ শিরান খলজি, আলী মর্দান খলজি, হুসাম উদ্দিন ইওয়াস খুলজী। এদের মধ্যে শিরান খলজি কে সৈন্যগণ তাদের নেতা হিসেবে মেনে নেয়। শিরান খলজি মাত্র এক বছর রাজত্ব পরিচালনা করতে পেরেছিল। পরে হূসাম খলজী ক্ষমতা গ্রহণ করেন। 

অন্যদিকে আলী মর্দান খলজি যিনি ইতিহাসে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী র হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত দুই বছর বাইরে থেকে এসে নিজেকে স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করে। দরবারের কিছু লোকের সহায়তায় তিনি শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সাধারণ প্রজাদের মধ্য তীব্র ক্ষোভ বেড়েই চলে। সকল খলজী মালিকরা এক হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এদিকে মর্দান খলজি নিজের নাম পরিবর্তন করে নিজের নাম রাখেন আলাউদ্দিন আলী মরদান খলজি। রাজ্যে এ কলহ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ‌, সাধারণ খলজি দের নিহত হন আলাউদ্দিন আলী মর্দান খলজি। ইওজ খলজি কে দ্বিতীয়বারের মতো সিংহাসনে বসানো হয়। হিসাব মতে ১২১২ থেকে ১২২৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি বাংলার সুলতান ছিলেন।

ইওজ খলজির নাম পরিবর্তনের কারণ


১৫ বছরের শাসনকর্তা ইওজ খলজি নিজের নাম সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি রাখেন। ইতিহাসে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি কে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তুর্কি বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে যদি কাউকে ধরা হয় তবে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নাম সর্বপ্রথম আসে।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজির বিশেষ অবদান সমূহ


ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বক্তিয়ার খলজির বাংলা শাসন ব্যবস্থাকে আরো সুদৃঢ় করার জন্য গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি প্রথমে শাসনকার্য সুন্দরভাবে পরিচালনা জন্য রাজধানী দেবকোট থেকে গৌড় স্থানান্তর করেন। রাজধানী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় দুর্গ নির্মাণ করেন উল্লেখযোগ্য দুর্গের মধ্য বসানকোট দুর্গ। তিনি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোর দেওয়ার জন্য অশ্ব বাহিনীর সাথে সাথে নৌবাহিনী গড়ে তোলে। 

এজন্য বাংলার শাসকদের মধ্যে সর্বপ্রথম নৌবাহিনী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হিসেবে গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি কে ধরা হয়। তার সময় কৃষিকাজ, সেচ ব্যবস্থা, সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন আসে। বন্যার প্রতিরোধের জন্য নানা ধরনের পরিখা খনন শুরু করেন, অসংখ্য পুকুর, খাল খনন করে। তার সময় রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়, ব্রিজ কালভার্ট সহ যোগাযোগ ব্যবস্থাএয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তার রাজ্যের প্রসারের দিকেও তিনি লক্ষ্য রেখেছেন, যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যের শাসকগণ বার্ষিক কর নিয়মিতভাবে পরিষদ করত।

সংস্কৃতিমনা সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি


তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা এক অনন্য দৃষ্টান্ত উদাহরণ। তিনি শিল্প-সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার প্রচেষ্টা য় বিখ্যাত গৌড়ের জুমা মসজিদ, অত্র অঞ্চলে এবং অন্যান্য মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা কদরের কারণে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সূফী-দরবেশ, কবিগন তার রাজদরবারে আগমন হত। তার প্রচেষ্টায় কারণে  লখনীতে মুসলমানদের বিশাল সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url