রাসায়নিক বন্ধন ও আয়নিক বন্ধন

রাসায়নিক বন্ধন কাকে বলে?


অণুতে বা পদার্থে পরমাণু বা আয়নসমূহ যে আকর্ষণী বলের সাহায্যে পরস্পর যুক্ত থাকে তাকে বন্ধন বলে। যেমন- হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণু রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হাইড্রোজেনের একটি অনু গঠনকরে। অনুরূপভাবে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু ও একটি অক্সিজেন পরমাণু রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একটি পানির অনু গঠন করে।

গঠন প্রকৃতি অনুসারে রাসায়নিক বন্ধন প্রধানত চার প্রকার। যথা:

১. আয়নিক বন্ধন
২. সমযোজী বা সহযোজী বন্ধন
৩. সন্নিবেশ বন্ধন ও
৪. ধাতব বন্ধন

এছাড়াও একই বা ভিন্ন পদার্থের পরমাণুর মধ্যে দুর্বল আকষনের উপর ভিত্তি = দুই প্রকার বন্ধন দেখা যায়। যথা:
১. হাইড্রোজেন বন্ধন
২. ভ্যানডার ওয়ালস শক্তি
আয়নিক বন্ধন এবং আয়নিক যৌগ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো:

আয়নিক বন্ধন কাকে বলে?

 
সাধারণত ধাতু এবং অধাতু পরমাণুর মধ্যে রাসায়নিক সংযোগ এর সময় ধাতব পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের এক বা একাধিক ইলেকট্রন কে অধাতব পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে স্থানান্তর করে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের সৃষ্টির মাধ্যমে যে বন্ধন গঠন করে তাকে  আয়নিক বা তড়িৎযোজী বন্ধন বলে।

অথবা 

রাসায়নিক বন্ধন গঠনকালে ইলেকট্রনের দানের মাধ্যমে ধনাত্মক আয়ন এবং ইলেকট্রন গ্রহণের মাধ্যমে -ঋণাত্মক আয়নের পরিণত হওয়াকে অর্থাৎ এভাবে এম বিপরীত আধান বিশিষ্ট আয়নের মাধ্যমে স্থির বিদ্যুৎ আকর্ষণের দ্বারা যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে আয়নিক বন্ধন বলে।

অথবা 

ইলেকট্রন স্থানান্তরের মাধ্যমে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের সৃষ্টির ফলে দুটি পরমাণুর মধ্যে যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে আয়নিক বা তড়িৎযোজী বন্ধন বলে।

আয়নিক যৌগ কি?

যে যৌগে আয়নিক বন্ধন থাকে তাকে আয়নিক যৌগ বলে।

আয়নিক যৌগের বৈশিষ্ট্য
 
 সাধারণ ধর্মাবলি নিম্নরূপ:

১. ভৌত অবস্থা: সকল আধুনিক যৌগসমূহ কঠিন অবস্থায় কেলাস বা স্ফটিকাকারে থাকে। যেমন- সোডিয়াম ক্লোরাইড একটি কঠিন কেলাস যৌগ।

২. মেরু প্রবণতা: আধুনিক যৌগসমূহের অনুতে একটি ধনাত্মক ও একটি ঋণাত্মক আধান প্রাপ্ত থাকে। যেমন NaCl এখন প্রান্ত Na এবং ঋণাত্মক প্রান্ত হলো cl-.

৩. গলনাংক ও স্ফুটনাকে: আয়নিক যৌগসমূহের গলনাংক ও স্ফুটনাংক খুব বেশি হয়। কারণ আয়নসমূহ স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল দ্বারা এমন দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে যে এদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে প্রচুর তাপ শক্তির প্রয়োজন হয়।

৪. দ্রাব্যতা :আয়নিক যৌগসমূহ অপোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় না কিন্তু পোলার দ্রাবকে দ্রবণীয়। যেমন- Naপনিতে দ্রবণীয় কিন্তু CCI4, -এ অদবনীয়।

৫. কঠিন অবস্থায় আয়নিক যৌগ বিদ্যুৎ অপরিবাহী। তড়িৎ পরিবাহিতা। আয়নিক বা তড়িৎযোজী যৌগসমূহ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবাহী।

৬. সমরূপতা: আয়নিক যৌগসমূহ সমরূপতা প্রদর্শন করে। যেমন- NaF ও MgO সমরূপী যৌগ।

৭. রাসায়নিক বিক্রিয়া: আয়নিক যৌগের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো এত দ্রুত ঘটে যে তাদের গতি নির্ধারণ করা খুব কঠিন।
 
৮. ভঙ্গুরতা: আয়নিক যৌগসমূহ ভঙ্গুর হয়।

আয়নিক বন্ধনের সীমাবদ্ধতা

১. অধাতব পরমাণুর মধ্যে আয়নিক বন্ধন গঠিত হয় না। দুটি বিপরীতধর্মী মৌল যেমন- ধাতু ও অধাতুর মধ্যে আযনিক বন্ধন গঠিত হয়।

২. কোন রাসায়নিক বন্ধনই ১০০% আয়নিক হয় না। প্রায় ক্ষেত্রেই আংশিক আয়নিক বন্ধন গঠিত হয়। 
 
৩.  আয়নিক বন্ধনে একাধিক ইলেকট্রন ত্যাগ করে যা গ্রহণের জন্য অধিক শক্তির প্রয়োজন হয়। এজন্য আয়নিক বন্ধনে উচ্চ আধানযুক্ত আয়ন খুব কমই গঠিত হয়। যেমন- ফ্লোরিন পরমাণু F আয়ন গঠন করে কিন্তু F- গঠন করে না। 

৪. অনেক ক্যাটায়নে অষ্টক নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়। এদের সর্ববহিস্থ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনিক গঠন S2  p6  d10, S2 p6 নয়।ধরি, cu+, zn+ এদের ক্ষেত্রে সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনিক গঠন 3s2 3p6 3d10 

৫. ধাতু ও অধাতুর মধ্যে বন্ধনে আয়নিক বন্ধনের বিশেষ অবদান থাকলেও তাদেরকে আসলে আয়নিক যৌগ বলা যায় না যেমন Alcl3 যৌগে আয়নিক বৈশিষ্ট্য কম রয়েছে অর্থাৎ আয়নিক ধর্ম কম রয়েছে।

৬. সব ধাতুর সাথে সব অধাতুর আয়নিক বন্ধন সৃষ্টি না হতে পারে।

আয়নিক বন্ধন গঠনের শর্তসমূহ

১. নিম্ন আয়নীকরণ শক্তি: আয়নীকরণ শক্তি অর্থাৎ পরমাণুগুলোর মধ্য একটির আয়নীকরণ শক্তি কম হওয়া প্রয়োজন। আয়নিকরণ শক্তি কম হলে সামান্য শক্তি প্রয়োগে এটিকে ক্যাটায়ন এ পরিবর্তন করা যায়।

২. উচ্চ ইলেকট্রন আসক্তি: অপর পরমাণুর ইলেকট্রন আসক্তি অধিক হওয়া প্রয়োজন। এতে পরমাণুটি অ্যানায়নে পরিণত হওয়ার সময় প্রচুর শক্তির উৎপত্তি ঘটে। 

৩. উচ্চ ল্যাটিস শক্তি: ল্যাটিস শক্তি যত বেশি হয় আয়নিক যৌগের স্থিতিশীলতাও তত বেশি হয় এবং বিপরীত চার্জযুক্ত আয়নসমূহের মধ্যে আকর্ষণ তত বেশি হয়। 

৪. নিউক্লিয়াসের দূরত্ব: পরমাণুর সর্বশেষ স্তরটি অবশ্যই নিউক্লিয়াস হতে যথাযথ দূরত্বে অবস্থিত হতে হয়, যাতে সর্বশেষ স্তরের ইলেকট্রন অপসারণ সহজে ঘটে। 

৫. তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য: দুটি মৌলের মধ্যে আয়নিক বন্ধন গঠন সহজ হবে যদি তাদের মধ্যে তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য বেশি হয়। সাধারণত দুটি মৌলের মধ্যে তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য দুই বা তার বেশি হলে আয়নিক বন্ধন গঠন সহজতর হয়।

আয়নিক বন্ধন গঠন ব্যাখ্যা


রসায়নিক বন্ধন গঠনের সময় একটি পরমাণু ইলেকট্রন দান করে ধনাত্মক আয়নে পরিণত হয় এবং অন্য গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়। এই দুই বিপরীত আধানবিশিষ্ট আয়নের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ শক্ত দ্বারা যে রাসায়নিক বন্ধন গঠিত হয় তাকে আয়নিক বন্ধন বলে। যেমন- NaCl একটি আয়নিক যৌগ। আয়নিক বন্ধনের গঠন প্রক্রিয়া নিম্নের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। সোডিয়াম ও ক্লোরিন পরমাণুর ইলেকট্রন ভ্যাস নিমরূপ। Na (11) = 1s2 2s2  2p6  3s1

Cl (17) = 1s2  2s2  2p6  3s2  3p5 সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণুর মধ্যে যৌগ গঠনের সময় সোডিয়াম পরমাণু থেকে ক্লোরিন পরমাণুর বহিঃস্তরে কেটি ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হলে সোডিয়াম পরমাণু তার নিকটবর্তী নিষ্ক্রিয় গ্যাস নিয়ন এবং ক্লোরিন পরমাণুর তার নিকটবর্তী নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গনের স্থিতিশীল ইলেকট্রনীয় কাঠামো লাভ করে। এভাবে উভয় মৌলই বহিঃস্তরে অষ্টক ইলেকট্রনীয় কাঠামো লাভ করতে গিয়ে সোডিয়াম একক ধনাত্মক আয়ন Na+ এবং ক্লোরিন একক ঋণাত্মক আয়ন CI-এ পরিণত হয়। অতঃপর এই বিপরীত চার্জযুক্ত Na+ এবং CI-আয়ন স্থির বিদ্যুৎ আকর্ষণ শক্তি দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে আয়নিক যৌগ গঠন করে। অতএব সোডিয়াম ক্লোরাইড অণুর গঠন নিম্নরূপে দেখানো যায় Na------- Na+   + e-
 
Cl+e- ____cl-

Na +cl----Na+ +cl-=Nacl

এখানে ধাতব পরমাণু যতটি ইলেকট্রন বর্জন করে, অধাতব পরমাণু ঠিক ততটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে যাতে মোট সৃষ্ট নাহক ও ঋণাত্মক চার্জের সংখ্যা সমান হয়। এর ফলে সামগ্রিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ স্থিতিশীল অণু গঠিত হয়। 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url